

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে সৃষ্ট ভূমিকম্পে এবার কেঁপে উঠেছে সিলেটে। রবিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে রিখটার স্কেলে ৪ মাত্রার এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তি মূলত ডাউকি ফল্ট (ডাউকি চ্যুতি) অঞ্চলে।
মাঝারি মাত্রার এ ভূমিকম্প কী সংকেত দিচ্ছে আমাদেরকে? কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছেন সিলেটবাসী এবং রাজধানীবাসীরা। সিলেট ভয়েসের সাথে সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও ভূতত্ত্ব গবেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিলেট ভয়েসের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দ্বোহা চৌধুরী।
সিলেট ভয়েস: সিলেটে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্প সম্পর্কে বলবেন।
ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার: এ ভুমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছাতক থেকে ৯ কিলোমিটার পশ্চিমে, মুলত সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মধ্যে, ডাউকি ফল্ট লাইনে। ডাউকি ফল্ট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এটি উত্তরে ভূমিকম্পের একটি উৎস।
আমাদের প্রধান দুটি উৎস রয়েছে বড় ভূমিকম্পের। উত্তরে ডাউকি ফল্ট এবং পূর্বে চট্টগ্রামের পাশে পাহাড়ি অঞ্চলে ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন যেটা আরো ভয়াবহ।
সিলেট ভয়েস: ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ডাউকি ফল্ট। এই ফল্টের ইতিহাস কী বলছে?
ড. হুমায়ুন: গতবছরও ফেব্রুয়ারি মাসে ডাউকি ফল্টে ৪, ৪.৮ এরকম মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে কিছু সময়ের ব্যবধানে। এই ফল্টে শেষ যে বড় ভূমিকম্প হয়েছে সেটি হলো ১৮৯৭ সালে। শক্তির পরিমাপে ৮.২ মাত্রার।
সে ভূমিকম্পে মেঘালয়, আসাম, বর্তমানের বাংলাদেশ মিলে ১৫শ’র বেশি লোকের প্রাণহানি হয়, তার মধ্যে ঢাকায় ৫ জন ছিলেন। ঐ সময় ব্রিটিশরা যারা ছিল, তারা এত আতঙ্কিত হয় যে তারা রমনায় তাবু গেড়ে এবং বুড়িগঙ্গায় লঞ্চে বসবাস শুরু করে। এভাবে প্রায় মাসদুয়েক অবস্থান করে তারা।
এর আগে ১৭৮৭ সালে বড় ভূমিকম্প হয় ডাউকি ফল্টের পূর্বপ্রান্তে। এ ভুমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে যায়। আগে যেটা ময়মনসিংহ দিয়ে প্রবাহিত হতো। ভূমিকম্পের পরে বর্ষা আসলে দেখা গেলো ব্রহ্মপুত্র নদের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে এবং এখন যেটা যমুনা নদী, পানি গতিপথ পাল্টে সেদিক দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে।
সিলেট ভয়েস: ডাউকি ফল্ট এখন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ?
ড. হুমায়ুন: আমরা গবেষণায় দেখেছি যে ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্ত এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ৭.৫ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প হওয়ার মতো শক্তি জমা হয়ে আছে।
সিলেট ভয়েস: এই মাত্রার ভূমিকম্পের কী ধরণের ক্ষতির আশঙ্কা করা যায়?
ড. হুমায়ুন: ভূমিকম্প ডাউকি ফল্টেই হোক বা ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোনেই হোক– যেহেতু দুইটাই বড় উৎস এবং ম্যাচিউরড অবস্থায় রয়েছে– দুইটা থেকেই রাজধানী ঢাকা ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি দুরত্বে। আর উৎসের কাছাকাছি সিলেট আছে, ময়মনসিংহ আছে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া আছে।
কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি হবে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। কারণ ঢাকা হচ্ছে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫ থেকে ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করছেন। এবং এই মহানগরী অপরিকল্পিত এবং অনিয়ন্ত্রিত। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ভূমিকম্পের সময় কী করণীয় এই জ্ঞান নেই।
এই অবস্থায় ৭ বা সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই দুইটা জোনে, তাহলে ঢাকা শহরেই তাৎক্ষণিকভাবে দুই থেকে ৪ লক্ষ লোকের প্রাণহানি হবে। এবং পরবর্তীতে বিল্ডিংয়ে আটকা পড়ে, আগুন ধরে, অনাহারে, চিকিৎসার অভাবে– কারণ রেসকিউ টিম যেতে পারবে না।
ঢাকা মৃত্যুপুরী হবে। এমন হতে পারে ঢাকা মহানগরীকে পরিত্যক্ত নগরী হিসেবে ঘোষণা করতে সরকার বাধ্য হতে পারে।
সিলেট ভয়েস: সিলেট শহরের বাস্তবতা কী হতে পারে?
ড. হুমায়ুন: বছর তিনেক আগে একই দিনে ভোরবেলা ৩/৪বার ভূমিকম্প হয় এবং সিলেট নগরীর অনেকগুলো ভবনে ফাটল দেখা দেয়। বাস্তবতা ঢাকার জন্য যা, সিলেটের জন্য একই।
সিলেটে একসময় আসাম টাইপের বর্গা-ব্যাটনের টিনের ছাদের বাড়ি ছিল, শহরের মধ্যে ছোটখাটো টিলা ছিল, এখন সব সমতল করে হাইরাইজ বিল্ডিং করেছে।
একটা প্রবাদ আছে, ‘ন্যাচার টু বি কমান্ডেড, মাস্ট বি ওবেইড’। আপনি ন্যাচারের বিপরীতে গেলে হবে না, সে তার নিজের মতোই চলবে।
সিলেট ভয়েস: এখন করণীয় কী? সরকারি উদ্যোগই বা কী হওয়া উচিত?
ড. হুমায়ুন: আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর তাদের উদ্যোগকে ভূমিকম্পের প্রস্তুতি না নিয়ে মূলত ভূমিকম্প উদ্ধার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সেটা পরিচালনার জন্য কোটি কোটি টাকার বাজেট, হেভি মেশিনারি কেনা হচ্ছে।
কিন্তু ভূমিকম্পের আগে যদি মানুষকে প্রস্তুত করতে পারি– কারণ আমাকে তো এই অবস্থার মধ্যেই বসবাস করতে হবে কারণ এই ভবন তো পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিবেশে কীভাবে নিরাপদ থাকতে পারি তা জনগণকে শেখাতে পারি। স্মার্টফোনের মাধ্যমেই তরুণদের শেখাতে পারি, তরুণদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতে পারে যাতে তারা দ্রুত আত্মস্থ করতে পারে যে কোন পর্যায়ে কী করতে হবে। মাত্র ৬ মাসের প্রোগ্রাম নিয়েই জাতিকে প্রস্তুত করা যাবে।
এক্ষেত্রে প্রচুর মহড়া করতে হবে যাতে মানসিক মনোবল বৃদ্ধি পায়। যেভাবে বিজ্ঞান ক্লাসে তাত্ত্বিকের পর ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখতে হয়, তাতে নলেজ অর্জনের পাশাপাশি ও ব্যবহারিকভাবেও শিখে গেলে আর ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হলো না। এবং দ্রুত নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে পারবে।
শেয়ার করুনঃ
মুক্তমত থেকে আরো পড়ুন
সিলেট, ভূমিকম্প, ঢাকা, ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার, ভূমিকম্প গবেষক, সাক্ষাৎকার, সিলেট ভয়েস