

শুক্রবার, ২রা আগস্ট ২০২৪। প্রতিটি ঘরে নিস্তব্ধতা, বাইরে সাউন্ড গ্রেনেড আর গুলির শব্দ। টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড এবং গাড়ির চাকার ধোঁয়ায় আকাশ প্রায়ান্ধকার।
আন্দোলনকারীরা আগের দিন রাতে জানালো, তারা জুমার নামাজের পর চারদিক থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাবিপ্রবির প্রধান ফটকে মিলিত হবে। দুপুর ২:৩০ এর দিকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে শাবির গেইটে উপস্থিত হয়।
পুলিশ ও সিআরটি ছিল সতর্ক অবস্থানে। পুলিশ জানায়, তারা হামলা করবে না, শিক্ষার্থীরা যেন শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে। কিন্তু খানিক পরেই পুলিশ তাদের ট্যাংক ও রিজার্ভ বাহিনী নিয়ে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে শুরু করে।
তখন আন্দোলনকারীরা গেইট থেকে মদিনা মার্কেটের দিকে মিছিল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সুরমা এলাকা পার হওয়ার আগেই পুলিশ পিছন থেকে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা শুরু করে। এলোপাতাড়ি গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই গেইটে ছিলাম আমি ও শাবিপ্রবি প্রতিনিধি মিশকাত। হামলা শুরু হওয়ার আগেই মঈন উদ্দিন মঞ্জু ভাই, মিশকাত আর মোসাহিদসহ আমরা বাইক নিয়ে মাউন্ড এডোরা হাসপাতালে চলে আসি।
হাসপাতালের পার্কিং-এ গাড়ি রেখে ভিডিও ধারণ শুরু করি। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে আমরা হাসপাতালের সামনে অবস্থান করি। এমন সময় পুলিশ হাসপাতালের দিকে ফায়ারিং শুরু করে। সাংবাদিক বলে বারবার ডাক দেয়ার পরও তারা গুলি ছোড়ে। টিয়ারশেলের ধোঁয়া ও গন্ধে আমরা অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়ি।
তখনই ৫টা ছররা গুলি আমার গায়ে এসে লাগে। একটি বুকে, একটি ঠোঁটে এবং আরেকটি চোখের নিচে এসে লাগে এবং আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। সাথে সাথে মিশকাত এবং আমার সহকর্মীরা আমাকে মাউন্ড এডোরার ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসকের সহায়তায় ১টি গুলি বের করতে পারলেও বাকিগুলো বের করা সম্ভব হয়নি।
পরে রাতেই আমাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। এক্সরের রিপোর্ট দেখে হাসপাতালের ডাক্তারর দুইটি গুলি বের করেন। পরে একদিন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরি । গুলির যন্ত্রনায় তখন খুব কষ্টে ছিলাম।
এক মাস পর ঢাকায় ৬জন সার্জারীর অধ্যাপককে দেখালাম। তারা পরামর্শ দিলেন অপারেশন করার জন্য। পরবর্তীতে সিলেট নগরীর নয়াসড়কের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও অধ্যাপক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ ভাই অপারেশন করে গুলি বের করেন। ঘটনার পর কিছুদিন পর পর শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলেও বর্তমানে আগের চেয়ে সুস্থ আছি।
জীবনের এমন কঠিন মুহূর্তে যারা আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন এবং যারা গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদ শুনে হাসপাতালে এসেছেন ও খোঁজ খবর নিয়েছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং জুলাই আন্দোলনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
জীবনের কঠিন সময়গুলোতে যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি পেয়েছি, তা কখনও ভুলবো না। আপনাদের দোয়া ও আর্শিবাদে বেঁচে আছি। শ্রদ্ধা জানাই সেই আন্দোলনে আহত ও শহীদ সবাইকে। জুলাই আন্দোলন শুধু একটি স্মৃতি নয়—আমার শরীরে এখনো সেই দিনের চিহ্ন রয়ে গেছে।
- লেখক: সিলেট ব্যুরো প্রধান, দৈনিক কালবেলা