জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী জীবন, কেন চাষাবাদ ছাড়ছেন হাওরের কৃষক?
কৃষি
প্রকাশঃ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
হাওরকেন্দ্রিক কৃষিই সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। কিন্তু এই ভিত্তি ক্রমেই ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। এক মৌসুমের ধানের ওপর নির্ভরশীল কৃষি, আগাম বন্যায় ফসলহানি, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে হাওরবাসীর জীবন আজ টালমাটাল। ফলে গ্রাম ছেড়ে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে শহরমুখী জীবনে।
সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল দেশের প্রধান বোরোধান উৎপাদনকেন্দ্র। দেশের মোট উৎপাদিত ধানের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ আসে এখান থেকে। কিন্তু হাওরে বছরে এক মৌসুমে ধান হয়।
গত বছর বাদ দিলে এর আগের প্রতিবছরই এপ্রিলের শুরুতেই অকালবন্যা হানা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে কয়েক দিনের ব্যবধানে হাজার হাজার একর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। আর এর প্রভাব শুধু কৃষকের ঘরে নয়, বরং স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমবাজার ও পরিবহন ব্যবস্থায়ও পড়ছে।
এছাড়া হাওরে ধান চাষাবাদ ব্যয়বহুল হওয়ায় পেশা পরিবর্তন করে মানুষজন চলে যাচ্ছেন রাজধানী, সিলেট শহর বা জেলা সদর এলাকায়। কৃষিকাজ বাদ দিয়ে কাজ করছেন গার্মেন্টস শিল্পে, বা চালাচ্ছেন ব্যাটারি চালিত রিকশা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্যানুসারে, হাওর অঞ্চলের চার জেলায় বোরো মৌসুমে মোট ৪ লাখ ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ২ লাখ ১৯ হাজার ৪৫০ হেক্টর, হবিগঞ্জে ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর, সিলেটে ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর এবং মৌলভীবাজারে ৫৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে।
এছাড়া সিলেট বিভাগে মোট আবাদী জমি আছে ৩১ লাখ ২২ হাজার একর। যার মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় ৯ লাখ ২৬ হাজার একর, সিলেটে ৮ লাখ ৫৩ হাজার একর, জমি: ৬ লাখ ৯২ হাজার একর, এবং হবিগঞ্জে ৬ লাখ ৫১ হাজার একর এবং মৌলভীবাজারে ৬ লাখ ৯২ হাজার একর আবাদীয় জায়গা রয়েছে। যার মধ্যে সিলেট বিভাগে ১ লাখ ৩৭ হাজার একর আবাদযোগ্য জমি অনাবাদি রয়ে গিয়েছে।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার কৃষক নুরুল ইসলাম এখন সুনামগঞ্জ শহরে দিনমজুরির কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘ধান ঘরে তোলার আগেই যদি ডুবে যায়, ধান লাগাতে যে পরিমান টাকা খরচ হয় সেই পরিমান টাকা তুলতে না পারা যায়, তাহলে শহরে এসে দিনমজুরি ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না।’
সিলেট নগরীতে রিকশা চালান হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার হাইল হাওর এলাকার কৃষক সাবাজ আলী। ২ বছর আগে কৃষিকাজ ছেড়ে জীবিকার পরিবর্তন করেছেন।
তিনি বলেন, ‘বাপ দাদাদের কাছে শুনতাম ধানকে সোনা বলা হতো, কিন্তু বর্তমান বাজারে এই সোনার কোন মূল্য নাই, সরকার যে দাম দেয় আর আমাদের জমি বর্গা এনে মহাজনের কাছ থেকে চাষাবাদ করে পরে শ্রমিক খরচ এসব দিয়া হাতে টাকা থাকে না। আয় থেকে ব্যয় বেশি যার কারণে ২০২৩ সালেই সব ছেড়ে এসে এখন সিলেটে রিকশা চালাই।’
অন্যদিকে, হাওরে ধান চাষাবাদে কৃষকের আগ্রহ হারানো জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন জলবায়ু বিষয় নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা। সিলেট বিভাগের বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন, অকাল বন্যা এবং ধান লাগানোর উপযুক্ত সময়ে পানি না পাওয়াকে দায়ী করছেন তারা।
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়কারী ও জলবায়ুকর্মী সোহানুর রহমান সিলেট ভয়েসকে বলেন, ‘সিলেটেসহ সারা বাংলাদেশের জলবায়ুর মধ্যেই বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আগে যে বৃষ্টিটা হতো পুরো মৌসুম জুড়ে সেই বৃষ্টিটা হচ্ছে কয়েক ঘন্টায়। আবার দেখাযায় এতো ভারি বৃষ্টিপাত হল সবকিছু তলিয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পানির স্তর এখন অনেক নিচের দিকে চলে যাওয়ায় কৃষকরা ধান চাষে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেন না সেচ দিতে। আমাদের অনেক সময় বাহিরের দেশের মানুষজন বলে বাংলাদেশে ৬ ঋতু বলেন তাহলে ঋতুর ভিন্নতা কই। আমাদেরকে বর্তমান জলবায়ুর বিষয়টি মাথায় রেখেই হাওরের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে হবে। তা না হলে হাওরে কৃষিকাজের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাবে।’
এদিকে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, হাওরে ঝুঁকি থাকলেও এখানকার ধানের ফলনই জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম ভরসা। কিন্তু এই ভরসা রক্ষা করতে হলে স্থানীয় অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেচনির্ভর আধুনিক কৃষি, ফসল বৈচিত্র্য, জলাধার উন্নয়ন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ ছাড়া টেকসই সমাধান আসবে না।
এ ব্যাপারে সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার দেবজিৎ সিংহ বলেন, ‘হাওরের কৃষকদের জীবমান উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। তাদের জন্য সরকার থেকে ভর্তুকি থেকে শুরু করে নানান প্রকল্প নেয়া হয়েছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোঃ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সিলেট বিভাগ হাওর কেন্দ্রিক হলেও এখানে ধান চাষাবাদে যে সমস্যা বড় হয়ে দাড়িয়েছে সেটা হচ্ছে সেচ সমস্যা। যে মৌসুমটাতে বোরো ধান রোপন হয় সেই সময়ই এখানে পানি পাওয়া যায় না। এছাড়া ভূ-গর্ভ থেকে পানি উত্তোলনের জন্য কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে আমাদের হাওরের পাশে যে খাল নদীগুলো রয়েছে সেগুলো যদি ড্রেজিং করা যায় তাহলে সেচের সমস্যা অধিকাংশ কমে যাবে কৃষকরা লাভবান হবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের ধান লাগানো বেড়ে ওঠার জন্য সময় প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ধান লাগাতে সময় যাচ্ছে আবার কাটার জন্য সময় না দিয়ে এপ্রিলের আবহাওয়ার উপর নির্ভর হতে হচ্ছে। সেজন্য অনেক সময় আমরা আগাম ধান কাটতে বাধ্য হই, কৃষকরা সেখান থেকে তেমন লাভবান হন না।’
এ কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষকদের কথা মাথায় রেখে দুইটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে একটি হল ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প যার মধ্য দিয়ে সিলেটের সুরমা কুশিয়ারা নদীগুলো এবং তার তীরবর্তী খালগুলো খনন করা হবে। তাছাড়া জলাধার উন্নয়ন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ যদি ঠিকমতো দেয়া যায় তাহলে তাহলে তাদের জীবনমানে পরিবর্তন আসবে।’
হাওর, কৃষি, অর্থনীতি, চাষাবাদ, জীবিকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ