ব্রিটিশ ভারতে তখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সবার নাগালে আসেনি। পাঠশালা, মক্তব, বিদ্যালয়ের কাঠামো অসম্পূর্ণ। তালপাতা, খাগের পাটিতে বর্ণপরিচয়ের পাঠ চলত গুরু মশাইয়ের বারান্দায়। বই ছিল না, শ্রেণিকক্ষও নয়—তবে ছিল দীক্ষা, আত্মবিশ্বাস আর মানসিক আলোর স্পর্শ।


আমি জন্মেছিলাম এমন এক পরিবারের বংশধর হিসেবে, যাঁর গুরু মশাই ছিলেন এক সত্যিকারের শিক্ষাগুরু। আর সেই গুরুর ছাত্র ছিলেন—অধ্যাপক ড. ছদরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী।


সামরিক শাসনের সময়, সিলেটে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য হিসেবে। তাঁর ওপর অর্পিত হয় এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব—শুধু ভবন নয়, গড়ে তুলতে হবে একটি স্বপ্নময় বিদ্যাপীঠ, যার ভিত্তি হবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মুক্তচিন্তার সম্মিলনে।


আমি তখন রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। একদিন সদ্যনিযুক্ত ভিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। পরিচয় জানার পর তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, পাশে এসে বসালেন। আবেগে বললেন—“যার হাত ধরে আমি প্রথম লেখা পড়া শিখেছিলাম, তাঁর নাতি আমার সামনে!” এই কথা বলে তিনি যেন স্মৃতির অতলে ডুবে গেলেন।


ঘরভর্তি দেশের বরেণ্য শিক্ষক-গবেষক। তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন—“সেই শিক্ষক না থাকলে আমি আসামের মেধা তালিকায় প্রথম হতে পারতাম না, পিএইচডি করতে পারতাম না, আজকের এ অবস্থানেও পৌঁছাতে পারতাম না।” একথা শুধু স্মরণ নয়, ছিল আজীবন কৃতজ্ঞতার আত্মঘোষণা।তিনি শুধু বলেই থেমে যাননি, তাঁর আত্মজীবনীর পাতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই স্মৃতির স্বাক্ষর। গুরুজীকে স্মরণ করেছেন বিস্ময় আর ভালোবাসার সঙ্গে। এমন বিনয় আর কৃতজ্ঞতাবোধ সাধারণে খুব একটা দেখা যায় না। 


তাঁর জীবনের শিক্ষা শুরু সিলেটে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক (১৯৫১) ও স্নাতকোত্তর (১৯৫৪)। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন স্ফটিকবিজ্ঞানে। পরে তিনি শিক্ষকতা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং লিবিয়ার আল-ফাতেহ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বত্রই নিজের জ্ঞানের দীপ্তি ছড়িয়ে গেছেন নিরবভাবে।


শাবিপ্রবি-তে দায়িত্ব নেওয়ার পর ছদরুদ্দিন চৌধুরী অমানুষিক পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলেন এক সবুজ, বিজ্ঞানভিত্তিক, মানবিক-নির্মিত বিদ্যাপীঠ। তাঁর চিন্তা শুধু ভবন বা একাডেমিক কাঠামো নয়—তিনি ভাবতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, গাছপালা, ছাত্রদের নৈতিকতা, শিক্ষকদের দায়বোধ নিয়েও। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় যেন হয়ে ওঠে জীবন্ত প্রতিষ্ঠান—মানুষ গড়ার কারখানা।


একবার দেশে গিয়েছিলাম, ২০১৫ সালের দিকে। তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম সিলেটের সুবিদবাজারের বাসায়। অসুস্থ শরীর, স্তব্ধ ভাষা। কিন্তু আমাকে চিনে নিয়েছিলেন। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। তারপর কেঁপে কেঁপে উচ্চারণ করেছিলেন—“তোমার দাদামশাই আমার জীবনের গুরু ছিলেন…”


সে মুহূর্তে তাঁর চোখে আমি দেখেছিলাম এক জীবনের ফিরে দেখা—জীবনভর নীতিনিষ্ঠ পথচলার এক অন্তর্মগ্ন ধ্যান।


ছদরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর সততা ছিল অবিচল, তাঁর নৈতিক অবস্থান ছিল অটল। এই কারণেই ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ভিসি থাকা অবস্থায় মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। তাঁর মতো একজন আলোকিত মানুষকে কখনো জাতীয় অধ্যাপক করা হয়নি। কারণ তিনি দলে ছিলেন না, দালালও ছিলেন না। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বোনেরা হয়তো হয়ে উঠেছেন জাতীয় অধ্যাপক, অথচ ছদরুদ্দিন চৌধুরীর মতো মানুষকে রাষ্ট্র ‘ভুলে’ গেছে। আসলে রাষ্ট্র যখন দল আর আত্মীয়তার গণ্ডিতে বন্দী হয়, তখন নৈতিকতা গায়েব হয়ে যায়।


তিনি ছিলেন পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত—সিলেট অঞ্চলের জন্য কাজ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হয়ে। সবুজে বিশ্বাস করতেন, মানুষের ভেতরেও সেই সবুজ নীরবতাকে খুঁজতেন।


২৩ জুলাই তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। ফুলবাড়ি গ্রামের সেই কৃষিপ্রধান পরিবেশ থেকে উঠে এসে, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিজ্ঞান, পরিবেশ, মানবিকতা আর মরমিবাদের এক মূর্ত প্রতীক।


এ লেখা কোনো আনুষ্ঠানিক স্মরণ নয়। এটি এক গুরুতুল্য শিক্ষকের পায়ে মাথা রাখার প্রচেষ্টা।


ছদরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ইতিহাস নন, ইতিহাসের নেপথ্যের আলো। যার শূন্যতা আজও নীরবে বাজে আমাদের বিদ্যাপীঠগুলোর সবগুলো দরজায়


  • লেখক: সম্পাদক, প্রথম আলো, উত্তর আমেরিকা
  • মূল লেখাটি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণে প্রকাশিত, সিলেট ভয়েসে পুনঃপ্রকাশিত।

Single News Bottom

শেয়ার করুনঃ

মুক্তমত থেকে আরো পড়ুন