ড. ইফতেখার আহমদ
আন্তর্জাতিক চা দিবস: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ও চা শিল্পে AI প্রযুক্তির ব্যবহার
প্রণবকান্তি দেব
প্রকাশঃ ২৩ এপ্রিল, ২০২৫ ২:০০ পূর্বাহ্ন
২৩ এপ্রিল। পৃথিবীর তাবৎ সৃজনমনস্ক মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। দিনটি বইপ্রেমীদের। ১৯৯৫ সাল থেকে তেইশে এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও নানা সূত্রমতে, ১৯২৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল স্পেনে পালিত হয়ে আসছিল বই দিবস। বই দিবসের মূল ধারণা আসে স্প্যানিশ লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত লেখক মিগেল দে কার্ভেন্তেসের অন্ধ অনুরাগী। কার্ভেন্তেসের মৃত্যু হয়েছিল ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। দিনটিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে স্পেনে দিবসটির প্রচলন করেন ক্লাভেল আন্দ্রেস।
অন্যদিকে, ২৩ এপ্রিলকে বিশ্বসাহিত্যের এক অদ্ভুত, অনুপম আলো ছড়ানো দিনও বলা চলে। এই দিনে জন্ম নেন কলম্বিয়ান লেখক ম্যানুয়েল মেহিয়া। একই দিনে নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, মিগেল দে কার্ভেন্তেস, এবং স্প্যানিশ পেরুভিয়ান লেখক ইনকা গার্তিলাসো লা ভেগা। জানা যায়, সবগুলো বিষয়ই বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে বেছে নেয়।
এবারের বই দিবসকে সামনে রেখে প্রথম যে ভাবনাটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো, আমাদের দেশে পাঠাভ্যাস ব্যাপারটি যেন তুমুল সংকটের মুখোমুখি। পাঠক যেন আজ কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে! পাঠাগার যেন দিনকে দিন অচেনা হয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছে! অথচ একটা সময় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রাখতো বইপ্রেমীরা। এমনকি নব্বইয়ের দশকের বাঙালি কিশোর-কিশোরীরা মা-বাবাকে লুকিয়ে, দুপুর - রাতের ঘুম বাদ দিয়ে বই পড়তে গিয়ে মায়ের হাতে মার খায়নি, বকুনি খায়নি- এমন খুব কমই পাওয়া যাবে। তাছাড়া ধার করে বই পড়া, ধার নিয়ে ফেরত না দেয়া, বইয়ের ভাঁজে প্রেমপত্র গোজে দেয়া ইত্যাদি মধু ছড়ানো স্মৃতি খুব সহজে ভুলে যাওয়ার মতো নয়। কিন্তু প্রযুক্তির আধুনিকায়নে এখন পড়ার আগ্রহ কমেছে। নানা সংকট চেপে ধরেছে পাঠাভ্যাসকে।
বড় পোড়ামুখো এই সময়টা। চোখ মেললেই দেখা যায়, স্ক্রীণে ডুবে আছে জীবন। হাওয়ায় দুলছে আমাদের জীবন সংলগ্ন গল্পগুলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সন্তানের হাসি-কান্না বিক্রি করে খাচ্ছে একদল উন্মাদ মা-বাবা। উন্মাদনা এমন যে, যত উলঙ্গ ততোই যেন সেলিব্রেটি, যতো অরুচি, অশ্লীল ততোই বাহবা মিলছে। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর, প্রসববেদনার যন্ত্রণা থেকে শুরু করে জন্ম মুহুর্ত-সবকিছুই 'দেখিয়ে দাও'। চারদিকে মনোবৈকল্যের জয়জয়কার, লাইক,কমেন্ট, শেয়ার, ভিউ এর কাছে মানুষ বন্দক রেখে দিচ্ছে মগজ। অসহিষ্ণুতাই যেন বীরত্ব। তুচ্ছকে দেবতা আর দেবতাকে তুচ্ছ বানানোর মৌসুম এখন। আমিই রাজা, আমিই পণ্ডিত, আমিই বুদ্ধিজীবী, আমি, আমিময় প্রতিদিন। নীতিবোধের স্খলনে মাথা ব্যাথা নেই। মানুষের কান্নাও এখন পণ্য। কখন যে, নিজের দোকানে নিজেই পণ্য হয়ে উঠছে মানুষ নিজেই বুঝতে পারছে না। বড় ভয় থরথর এই সময়। বিদ্যা, বুদ্ধি, হৃদয়বৃত্তির চর্চা থেকে দূরে যেতে যেতে এক অসাড়, নি:স্ব, নিস্প্রভ জড় পদার্থে পরিণত হতে চলেছে মানুষ। ফলে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকেই অচেনা মনে হচ্ছে তার।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মানুষের এই বিপন্নতার পেছনে বইপড়ার অভ্যাস কমে যাওয়া অন্যতম একটি কারণ। কেননা যুগে যুগে মানুষের সুকুমার বৃত্তিচর্চার অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে বই। কবিগুরুর ভাষায় , ‘‘ভালো বই আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়।’’ বিশেষজ্ঞেরাও বলছেন, সুস্থ মানসিকতার জন্য বই পড়া খুবই জরুরি। সৃজনশীলতা, মননশীলতা—এসব গুণাবলির বিকাশে বই খুব ভাল বন্ধু। বইপড়ার উপকারিতা সম্পর্কে জানে না, তেমন মানুষই হয়তো খোঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বই পড়ার ঝোঁক কমছে বলে অনুযোগ শোনা যায় ইদানীং। মানুষের বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মের এই ‘বই বিমুখতা’ কিংবা পাঠাভ্যাস থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে তার নানা দিক আমাদের সামনে ধরা দেয়। অনেকের মতে, মানুষের জীবনে প্রযুক্তি- নির্ভরতা বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ। বই অবসরের সঙ্গী হলেও আজকাল অবসরই পায় না মানুষ। তার চারপাশে অক্টোপাসের মতো ঘিরে আছে রাজ্যের ব্যস্ততা। ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরানোই দায়! সোশ্যাল মিডিয়া, গেমিং, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, চ্যাটজিপিটি আরও কত কি! অবসর কোথায়?
সাম্প্রতিককালে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে প্রযুক্তির কথা।ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো দখল করেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি বড় অংশ। রিলস, লাইভ ইত্যাদি কেড়ে নিচ্ছে মুল্যবান সময়। অন্যদিকে, নেটফ্লিক্স, ইউটিউব এবং ডিজনি প্লাসের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় মানুষ বিনোদনের জন্য বই পড়ার পরিবর্তে সিনেমা বা সিরিজ দেখাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। একই সঙ্গে, ভিডিও গেমগুলো তরুণ প্রজন্মের জন্য এক ধরনের নেশা তৈরি করেছে, যা তাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহকে কমিয়ে দিচ্ছে।
আবার দেখা যাচ্ছে আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা বই পড়ার অভ্যাসে বড় প্রভাব ফেলেছে। কর্মজীবন, পরিবার, এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই বই পড়ার জন্য সময় বের করতে পারেন না। আরেকটা ব্যাপার হলো, বর্তমান সময়ে মানুষের মন প্রোডাক্টিভিটির দিকে বেশি ঝুকছে। প্রফিট এন্ড লসে বিভক্ত পুরো সময়। ফলে, বইপড়া পরিগণিত হচ্ছে সময়ের অপচয় হিসাবে।
আবার এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা বইপড়ার প্রতি উৎসাহ সৃষ্টিতে অন্যতম একটি অন্তরায়। কেবল জিপিএ, সনদ, মুখস্তের প্রতিযোগিতা ইত্যাদির ভীড়ে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যাওয়ার সময় নেই শিক্ষার্থীদের। 'আউট বই' পড়াকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য অন্তরায় হিসেবেও দেখেন অনেকেই। স্কুল এবং কলেজে লাইব্রেরির ব্যবহার আগের মতো নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব, লাইব্রেরিয়ান না থাকা এবং লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা আছেই। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কিন্তু এভাবে হাহুতাশ করে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের পাঠাভ্যাস চর্চাকে বেগবান করতে হবে।
বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কেবল প্রযুক্তি আর উদভ্রান্ত সময়কে দোষ দিলে চলবে না। মা-বাবা শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পাড়া-মহল্লা কেন্দ্রিক পাঠাগারচর্চা জোরদারসহ শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এটা আশার কথা যে, বাংলাদেশে বেসরকারি, ব্যাক্তি উদ্যোগে বেশ ক'বছর ধরে মানুষকে বই পড়ায় উদ্ধুদ্ধ করার নানামুখী কার্যক্রম চলমান আছে। অনেক সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরন্তর বইয়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত পাঠচক্রসহ প্রান্তিক অঞ্চলে গড়ে উঠছে পাঠাগার। মানুষকে বইমুখী করতে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে নানা কর্মসূচী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ইনোভেটরে কথা। 'পাঠঋদ্ধ জীবনের খোঁজে ' শ্লোগান নিয়ে ইনোভেটর শিক্ষার্থীদের বইমুখী করতে কাজ করে যাচ্ছে দুই হাজার ছয় সাল থেকে। এভাবে আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সারা দেশজুড়ে কাজ করে চলছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এসব উদ্যোগ কতদিন চলমান থাকবে সেটিই আশংকার কথা।
পরিশেষে বলি, আমাদের উচিত পরিবর্তনকে সঙ্গী করে বই নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। প্রযুক্তির ওপর দায় না চাপিয়ে প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। আপনার, আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্য কেউ এসে গড়ে দেবে না, নিজের ঘরে প্রদীপটা জ্বালাতে হবে নিজেকেই। কেননা একজন হৃদয়বান, প্রজ্ঞাদীপ্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে বইয়ের কোন বিকল্পের সন্ধান আজও পাওয়া যায় নি। আজ বিশ্ব বই দিবসে কায়মনোবাক্যে আহবান জানাই, চলুন বইয়ের কাছে ফিরে যাই, বলি ফিরে এসো বুকে বই রেখে ঘুমিয়ে পড়া স্মৃতিগুলো। আমাদের স্কুল লাইব্রেরিগুলো জেগে উঠুক, রেলওয়ে বুক স্টলগুলোতে ফিরুক প্রাণ। আমাদের জন্মদিনে, বিয়েতে প্রীতি উপহার হয়ে ফিরে আসুক বই এবং বই। আমাদের ছুটির দিনে, ব্যস্ততার অবসরে বই পাক একটু আদর। বই বড় অদ্ভুত মায়াজাল বিছিয়ে জড়িয়ে রাখে মানুষকে। চলুন, আমরা বইয়ের কাছাকাছি থাকি, বইকে হৃদয়ের কাছাকাছি রাখি।