‘মউজ, মজে মউজ’। আমার লেখা ‘জলোপাখ্যান’ সিরিজের ‘জলজোছনা’ পর্বের গ্রন্থ। ফিকশন-ননফিকশন। সরস স্মৃতির পথে হেঁটে চলার একটি সত্য গল্প। এর আগে লিখেছি ‘জলজীবিকার জলোপাখ্যান- বারকি, জন বারকি’। আগেও বলেছি—এখনো বলি, উপাখ্যান থেকে জল-উপাখ্যান লিখতে নির্জনতার সেই সময়ে শব্দটি একাকার করে দিয়েছিলেন বনানবিশারদ কবি আবিদ ফয়সাল। তিনি এখন কানাডায়। দূর প্রবাসী হলেও তার মনের চোখ বাংলাদেশের দিকেই তাক করা। তো ‘বারকি’ ও ‘মউজ’ শব্দ দুটো নিয়ে তার ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস সীমানা পেরিয়ে। তার মতো করে পাঠকেরও জানতে চাওয়া রয়েছে। তাদেরকে লিখে নয়, ছোট্ট করে বলে কয়ে দায় সেরেছি। ইচ্ছে আছে, জলোপাখ্যান সিরিজ সুসম্পন্নের পর একসঙ্গে জানিয়ে দেব সব সঙ্গ-অনুষঙ্গ। 


আজ ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের এই দিনে একটি অঘটন দেশে ও বিদেশ কান্নায় ভাসিয়ে দিয়েছিল। অকালপ্রয়াণ অকস্মাৎ সব স্বপ্ন ভেঙে ছারখার করে দিয়েছিল। সুনামগঞ্জ পৌরসভার একটানা নির্বাচিত তিনবারের চেয়ারম্যান (তখন মেয়র বলা হতো না) কবি মমিনুল মউজদীন ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক পথের ব্রাম্মণবাড়িয়ার সরাইলের নিকট দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। সঙ্গে ছিল পুরো পরিবার। দুসন্তান ফিদেল নাহিয়ান ও কহলিল জিবরান এবং স্ত্রী তাহেরা চৌধুরী। 


প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন তাদের ব্যক্তিগত গাড়িচালক কবির মিয়া। ফিদেল নাহিয়ান ছাড়া সবাই স্পট ডেড। তরতাজা চারটি ডেডবডি নিয়ে সর্বত্র ডেডলক পরিস্থিতি। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তখন আক্রান্ত ‘সিডর’ নামের ঘূর্ণিঝড়ে। ওই রাতেই সিডর এল, মমিনুল মউজদীনেরও নিথর দেহ পৌঁছাল সুনামগঞ্জ শহরে। ‘এক জোড়া কালো চোখ... এ শহর ছেড়ে আমি পালাব কোথায়’ মাতম। 


মর্মান্তিক সেই ঘটনার বছরপূর্তির ২০০৮ থেকে এই দিনে লিখছি। জোছনাবাদে বুঁদ প্রজন্মের একজন হিসেবে দায়বোধ থেকে একের পর এক লেখা। এক অবসরে চিন্তা করলাম গ্রন্থবন্দি হোক। তা করতে গিয়ে অদ্ভুত এক মায়াজালে আক্রান্ত। ঘটনা নয়, তার সৃষ্ট কবিতায় মজে জল ভরা চোখ হাঁটে। ফিরতে পারি না। ‘হে আমার চৌতিরিশের ক্ষুব্ধ যৌবন’ কবিতার সুলুকসন্ধানে গিয়ে ধরা পড়ে ‘চৌতিরিশ’। কবি কিশোর সুকান্ত বলেছিলেন আঠারো। মউজদীন বুঝি আরও পরিপক্কতায় বয়স চৌতিরিশকে বেছে নেন। তিনি ওই বয়সে পৌরপিতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। একটি মানুষ পূর্ণ জীবন পেলে চৌতিরিশে পরিপক্ক হয়। আমরা তার জীবনের পরিপক্ক-কাল পেয়েছিলাম। কিন্তু পরিণতি এমন যে হবে, তা কস্মিনকালেও ভাবিনি। এ যেন নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত নিয়তি! 


নিয়তির গতি-প্রকৃতি ধরা বা স্পর্শ করার সাধ্য মানুষের নেই। তবে মানুষের মধ্যে মজে থাকার সাধ্য বা স্বাদ আছে। আমার মজে থাকার মউজ পুরোটা তাকে ঘিরে। মন মজালে বলে কথা! আমাদের আঠারোর তারুণ্যে একজন মমিনুল মউজদীনকে কাছে না পেলে বুঝতাম না জীবনানন্দ কারে কয়। রবীন্দ্রনাথের প্রেম কেন এত নিখাদ। কী কঠিন শ্রম-ঘামের জনপ্রতিবাদের জীবন। ফিদেল কাস্ত্রো-চে-মাও থেকে আমাদের ক্ষুদিরাম-তিতুমীর-সূর্যসেনদের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বলে পুরো জীবন পার করে দেওয়া। মজলুম জনতা জনার্দন হয়ে কথা বলা, জমিদারের রক্ত ধারার এক মউজদীন থেকে কেন এমন উচাটন বা আকুলতা? তার মর্মভেদ করেছিল কবিতা।


বাংলাদেশে কোন নির্বাচন হয়েছে কবিতা-স্লোগান-বক্তৃতা দিয়ে? নির্বাচিত হলে ‘কবিতার শহর’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে? কোন শহর জোছনালোকে নুইয়ে পড়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর-অন্তরালে ছিল নিখাদ প্রেম আর প্রকাশ্যে ছিল জনপ্রতিনিধির জনদরদি তথা দেশকে সাশ্রয়ী করা? 


বলছিলাম, পূর্ণিমারাতে সড়কবাতি নিভিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও জোছনা উপভোগ করার অসাধারণ উদ‍্যোগের কথা। সে কথায় গাথা ছিল আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের তাগাদা। বাংলাদেশে তখন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের উদ্ভাবনীচিন্তাকে পুরস্কৃত করার রেওয়াজ তৈরি হয়নি। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য ছিল। আমাদের মাতৃভাষার আন্দোলনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা, সুনামগঞ্জের প্রান্তিক একটি হাওরকে সুন্দরবনের পর জলাভূমির বিশ্ব ঐতিহ্য করার ধারায় সুনামগঞ্জ শহরে কৃত্রিম আলোকে বাদ দিয়ে প্রাকৃতিক তথা চাঁদের আলোকে ব্যবহারের বিষয়টি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতির এক সুকীর্তিতে মেতেছিলাম। কিন্তু নেতৃত্বের মানুষটি তার জীবন অকালে অকস্মাৎ সমাপ্ত করে চলে যাওয়ায় থেমে গেল সব!


সবই এখন ছবি! পাঠ করি গ্রন্থের সূত্রপাত কথা। "...সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত। শহর ঘুরে যাদের দেখা পেয়েছি, তাদেরই কথা নোট করেছি। চকিত জরিপের মতো। বাদ যায়নি পূর্ণিমারাতে হারিকেন না জ্বালিয়ে জ্বালানি সাশ্রয়ী রিকশাচালকের কথাও। মত-দ্বিমত ছিল। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/ পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি...’। সুকান্তের কবিতার লাইন আউড়িয়ে খেদুক্তিও করেছিলেন কেউ কেউ। 


খেদুক্তি কিংবা স্বগতোক্তি—লেখায় সবার কথা রাখতে চাই। পরের রাতেই লিখতে বসলাম। লেখাটা কোথা থেকে, ঠিক কিভাবে শুরু করবো? নিজের মধ্যে টান-টান টানাপোড়েন। কথা বলি বড় ভাই ইকবাল হোসাইন খানের সঙ্গে। তিনি তখন সাংবাদিকতা ছেড়ে সবেমাত্র ব্যাংকে চাকরি নিয়েছেন। সিলেটের বিয়ানীবাজারে থাকেন। টেলিফোনে কথা বললাম। বিষয়বস্তু শুনে লেখার আগে মনসংযোগের জন্য তিনি কিছু পরামর্শ দেন। নিজের জানার মধ্যে কী কী তথ্য আছে তা পরখ করা, পূর্ণিমা-চাঁদ নিয়ে কিছু গান শোনা, লেখা বা কবিতা পড়া। এমন মনোনিবেশ থেকে লেখা সমৃদ্ধ হবে। 


কবি আল মাহমুদের না ঘুমানোর দল কবিতায় চোখ রাখি। ‘নারকেলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল/ ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল...’। আরও কিছু কবিতা পড়ে গানও শোনা হয় ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে...’। লিখতে বসে রাত পেরিয়ে ভোর। খেয়ালই নেই। অনেক কাগজ নষ্ট করে লেখাটি প্রস্তুত। মনমতো না-হলেও হয়তো হলো। দুপুরের আগেই লেখা পাঠালাম ফ্যাক্সে, ছবি ডাক মারফতে। ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ ছিল বলে টেলিফোন করে সঞ্জীব চৌধুরীকে জানালাম। এরপর আর যোগাযোগ নেই। লেখাটি মনোঃপুত হলো না বাদ পড়ল, তা-ও জানতে পারছিলাম না। 


ভোরের কাগজ-এর মেলা ফিচার পাতাটি তখন সব বয়সের পাঠকের প্রিয়। কাটতি বেশি। সাদাকালো পাতা। দুরঙা। কেবল লেখার শিরোনাম রঙচঙা। প্রকাশ হতো সপ্তাহে একদিন, সোমবার। আগের দিন মূল পত্রিকায় হাইলাইটস থাকতো। কিন্তু এই রোববারে মেলার হাইলাইটসও ছিল না। পরদিন সোমবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭। মূল পত্রিকা হাতে নিয়ে সবার আগে মেলায় চোখ। রাত ঘুরে, রাত জেগে তৈরি আমার লেখা প্রধান ফিচার—‘সুনামগঞ্জে সাশ্রয়ী চাঁদ : আকাশ ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে’! 


সেই থেকে সুনামগঞ্জ জোছনার শহর। কবিতার শহর জোছনায় জলতল! জলজোছনার শহর। এই একটি বিষয়ে পাঠক প্রতিক্রিয়া এতোটা ছিল যে, পরবর্তী ছয় মাস ভরা চিঠিপত্র কলামে ছোট ছোট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ছাপা হতে থাকে। পত্রমিতালীর মতো আমার ঠিকানাতেও আসে কিছু চিঠিপত্র। সহযোগী পত্রিকাগুলোতেও নানা অনুষঙ্গে চলছিল এ নিয়ে লেখালেখি। 


এভাবে প্রায় এক দশক, এরপর এক নভেম্বর মাসে প্রায় একই সময়ে সঞ্জীব-মউজদীন অকালে অকস্মাৎ পাড়ি দেন পরপারে। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দুপুরবেলা ঢাকা থেকে ফেরার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মমিনুল মউজদীন, সহধর্মিনী তাহেরা চৌধুরী, তাঁদের ছোট ছেলে কহলিল জিবরান, গাড়িচালক কবির মিয়া ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনার দিন রাতে সঞ্জীব চৌধুরীও আকস্মিক মস্তিস্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে অবচেতন, সংজ্ঞাহীন হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে। ফেরা হয়নি আর তাঁর! মারা যান ১৯ নভেম্বর। জোছনাবাদী মউজদীন-সঞ্জীবভক্তদের জন্য এ যেন নভেম্বর ভয়ংকর।


‘আকাশ ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে’ লেখার প্রধানতম অবলম্বন ছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। লোডশেডিংয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী উদ্যোগ। ফিচারটি প্রকাশ হওয়ার পর বিদ্যুৎ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মন্ত্রিপরিষদের একটি বৈঠক থেকে তৎকালীন সচিব বিরল দৃষ্টান্ত বলে অভিহিত করেছিলেন। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে যে সকল শহর সুনামগঞ্জের মতো, যে সকল পৌরসভায় মমিনুল মউজদীনের মতো চেয়ারম্যান আছেন, সেই সব শহরে এ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।  


দশক দুই পর-লোডশেডিংকে প্রায় ভুলে যাওয়ার সময়ে ২০২২ সালে আবার বিদ্যুৎ সাশ্রয় করার তাগিদ। কারণ বৈশ্বিক। ঘাটতি মোকাবিলায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের তাগাদা যখন সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছিল, তখন সেই সময়ের কয়েক পাঠক মনে করিয়ে দেন জোছনাবাদে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের অসাধারণ উদ্যোগটি। 


মনে আনন্দ। আবার আসবে ফিরে! কিন্তু উদ্যোক্তা নেই উদ্যোগটিও নেই-কে ফেরাবে? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, লেখা দিয়ে ছবি আঁকা যায়। দেখায়-লেখায় আঁকা হয়েছে চাঁদের আলো থেকে জোছনা। জলে পড়ে আরও জ্বলে। আলো জলমল-জলজোছনা। 


সমাজবিশ্লেষকেরা বলেন, প্রকৃতিকে প্রকৃত রেখে চলতে পারাটা সংস্কৃতি। প্রকৃতি-সংস্কৃতিই সরলরেখা। এই রেখাপাতে বা সরলতার সারল্যে জন্ম নিয়েছিল জোছনাবাদ। যা কেবল লেখায় আঁকা দেখার বিষয়। 

কী চোখে দেখেছি? সেই দেখা বরণের পর হরণ এখন। হরণ আহরণে রক্তক্ষরণে বিষণ্ন-তারুণ্য। বিষণ্নতার বিনাশে ফেরাতে হবে জোছনাবাদ। নগ্ন জলে মগ্ন আমি পারি, না-পারি—অগ্রগামী অন্য কোনো উজ্জ্বল মেহেদী পারবে। 


জলজোছনার শহরে একদিন জোছনাবাদ ফিরবে! ফেরার আনন্দে ফিরে যাতে অর্জুন চিনতে ফেরারী হতে না হয়, এ জন্যেই এই জলজোছনার জলোপাখ্যান—মউজ, মজে মউজ।"


সূত্রপাত শেষ। জোলজোছনার জলোপাখ্যান পর্ব। শুরুতেই সত্য পাঠ।


"এক/ 

জল-জোয়ারে জলোচ্ছ্বাস। আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। তটস্থ জল-ডাঙা। সন্ত্রস্ত মানুষ। বুকে দক্ষিণের ধুকপুক। বিপদসংকুল সমুদ্র উপকূল। সচল কেবল উত্তরপূর্বের মহাসড়ক পথ। যানবাহন চলছিল আবহাওয়ার বার্তা বয়ে। এফএম রেডিওতে ঘুরেফিরে সিডরের পূর্বাভাস। আকাশ মেঘলা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, বাতাস বৈরী-হঠাৎ হন্য যাত্রীবাহী এক বাস। মুহূর্তেই মুখোমুখি। ধুমড়েমুচড়ে গেল বাসের বিপরীতে থাকা প্রাইভেট কার। থমকে যায় মহাসড়কে চলার মহাসমারোহ। 


অপরাহ্নে অপঘাত! তারিখ ১৫ নভেম্বর, ২০০৭ সাল। সিডরের আগে অন্য এক সিডর। আক্রান্ত-ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব প্রান্তিক। যেন প্রাণহীন প্রান্তজন। 


দুই/ 


জলজ্যান্ত এক মউজদীন। দেওয়ান মমিনুল মউজদীন। বয়স বায়ান্ন। অবয়ব—চৌতিরিশের ক্ষুব্ধ যৌবন। সদা সুদর্শন। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। একহারা গড়ন। সবল লম্বা দেহ কাঠামো। নম্র ও বিনয়ী স¡ভাব। নিষ্পাপ কমনীয়তা। মুখে মোহনীয় ভাব, শিশুর সারল্য-হাসিরাশি। রুচিশীল-সৃজনশীল। ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি। পোষাক পড়েন প্রকৃতির সাজে। সরস সাহসী, প্রতিবাদী। তাক লাগানো তারুণ্য। পথ চলেন তোলপাড় বেগে। একজোড়া কালো চোখ চিন্তা খেলা করে। কথায় মজে থাকার মন্ত্রমুগ্ধতা। চন্দ্রাহত নন, চন্দ্রালোকপিয়াসী। কবিতা লিখেন, তবে কবিদের মতো নন। রাজনীতি করেন, রাজনীতিবিদের মতো নন। পৌরপিতা, তবে পিতা নন—ত্রাতা। ভাবনায় দার্শনিকের অন্যমনস্কতা। মননে মস্ত এক হাসন রাজা। মজে থাকেন মানুষের মউজে। 


এই মমিনুল মউজদীন ও তার পুরো পরিবার দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেট কার-যাত্রী। ঢাকার উত্তরা থেকে ফিরছিলেন নিজ শহরে। এক সিটে পাশপাশি সহধর্মিনী তাহেরা চৌধুরী, ছোট ছেলে কহলিল জিবরান। সামনে চালকের পাশের সিটে বড় ছেলে ফিদেল নাহিয়ান। তারা চারজন আর গাড়িচালক। মোট পাঁচজন। মহাসড়কের উজানভাটিতে যমের করতলে। কে, কাকে, কী করে রক্ষা করবে? পলকে সবাই চাপা! 

ঘটনার সময় মিনিটের হিসেবে নয়, সেকেন্ডের চেয়ে দ্রুত। সব মিলিয়ে কতক্ষণ? বড়জোর বায়ান্ন সেকেন্ড! চিৎকার দিয়ে মউজদীন ডাকেন বড় ছেলে নাহিয়ানকে। চলে যায় পাঁচ সেকেন্ড। চমকিত-হতচকিত নাহিয়ান। তন্দ্রাচ্ছন্ন থেকে বাবার ডাকে জেগে ওঠে। মাথা ঘুরাতেই একাংশ রক্ষা। আরও পাঁচ সেকেন্ড পার। বাকি আট সেকেন্ডে চারজনের তিনজন একসঙ্গে, আর্তির আগেই তারা শেষ! মাত্র আঠারো সেকেন্ড আগের জীবন্ত-প্রাণবন্ত শরীরগুলো গাড়ির যন্ত্রাংশের মতোই। চুর্ণবিচুর্ণ। কিছুই নেই আর বাকি। বায়ান্ন থেকে চলে গেল আঠারো। থাকল চৌতিরিশ সেকেন্ড। 


তখন ঘড়িতে বাজে অন্ধকার! সবাই ভাবছে বেহুঁশ। আসলে হুঁশবুশহীন নন মউজদীন। পড়ে আছেন মহাসড়কে, বাংলাদেশের উজানভাটির মাটিতে। মহাব্যথিত চিত্তে চিৎ হয়ে। মাথার একপাশ চ্যাঁছা জখম। কপালে চিড়। চইতের জমির মতো চৌচির। হাত-পা অবশ। নড়াচড়ারও সাধ্য নেই। নিজের বশে কিছুই নেই। দুনিয়ার সবচেয়ে ভারী কিছুর ভার মনে। ভারে ভারাক্রান্ত। 


কপালের চিড় থেকে নালা। রক্তনালা। জলস্রোতের মতো করে রক্ত বেরুচ্ছে। মুখ ভিজিয়ে রক্ত গড়িয়ে মুখেও ঢুকছে। রক্তের স্বাদ কেমন? নোনতা, সমুদ্রের নোনাজলের মতো। একজোড়া কালো চোখ রক্তে সজল। দেখার শক্তিটুকু আছে বৈ। তবে নিভু নিভু। ওঠে দাঁড়াতে চাইছিলেন। পারলেন না। নিঃশ্বাসে দমবন্ধ অবস্থা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। ফেরারী শ্বাস-প্রশ্বাস। পালাতে গিয়ে কোথায় যেন আটকে যায়। আবার ফিরে ফিরে আসে। বুকের ধরফড়ানি শরীরজুড়ে। অক্সিজেন লেভেলে তীব্র ওঠানামা। সামনে যেন কী অপেক্ষা করছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো ‘সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার’ তার। 


অনন্ত জীবনের পথে মউজদীন। স্ট্রিট মার্ডার—পথে হত্যা বা মৃত্যুর মুখোমুখি। এই পথ পরিক্রমায় একে একে মনে পড়ছিল সব। মজে মজে ভাবছিলেন ভালোবাসার শহরের কথা। শহরটানে ভাসছিল জনপ্রতিনিধির সময়কাল। ..."


একজন মউজদীনকে নিয়ে ‘মউজে’ মানুষে এভাবেই মজেছিলাম। কথা ছিল জলজোছনা পর্বের সিরিজটির নাম ‘আকাশ ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে’ হবে। কিন্তু মৌলিকত্বের চিন্তায় এ নামটি বাদ দিতে হলো। মন যেহেতু মজেছিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মজে রাখা জিইয়ে রাখতেই ‘মউজ, মজে মউজ’। 


গ্রন্থে আছে সেই চৌতিরিশ অনুপ্রাস। বাছাই করা ৩৪টি কবিতা, জীবন ও মৃত্যুর ৩৪ সেকেন্ড আর ৩৪ অনুচ্ছেদে লেখা, শেষ করতে লেগেছিল ৩৪ রাত। জলোপাখ্যান প্রকাশক চৈতন্য প্রকাশনের কর্ণধার রাজীব চৌধুরীও চৌতিরিশ অনুপ্রাসে ঢাকায় ২০২৩ সালের একুশে গ্রন্থমেলা সমাপ্তির ঠিক ৩৪ ঘন্টা আগে পাঠজাত মানে বাজারজাত করেছিলেন।


শেয়ার করুনঃ