হাফিজ মাওলানা ফখর উদ্দিন

শিক্ষা মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি মানুষের জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে জীবনে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তবে শিক্ষা শুধুমাত্র একটি মাধ্যম নয়; এটি মানুষের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং পার্থিব জীবনের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। ইসলামিক শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষা, এ দুই ধারা শিক্ষা ব্যবস্থার দুই ভিন্ন দিক। এই প্রবন্ধে আমরা উভয়ের মূল বিষয়, পার্থক্য, প্রাসঙ্গিকতা এবং সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করব।

ইসলামিক শিক্ষা


ইসলামিক শিক্ষা আল্লাহর বাণী তথা পবিত্র কুরআন এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর হাদিসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এটি মানুষের অন্তর্নিহিত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশে সহায়তা করে। ইসলামিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তার দেয়া বিধান অনুযায়ী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র পরিচালনা করা।

ইসলামিক শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হয়। এটি মানুষের মাঝে সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং দায়িত্বশীল মানসিকতা তৈরি করে। এই শিক্ষা মানুষকে পরকালের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে এবং মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায়।

দারুল উলুম, মাদ্রাসা এবং ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইসলামিক শিক্ষার মূল কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠানে কুরআন-হাদিসের পাশাপাশি ইসলামের ফিকহ, তাফসির, আকিদাহ, এবং ইতিহাসের ওপর জ্ঞানার্জনের সুযোগ থাকে। এছাড়াও ইসলামিক শিক্ষা মানুষকে মানবিক মূল্যবোধ শেখায়, যা সমাজে শান্তি ও সাম্যের পরিবেশ তৈরি করে।

ইসলামিক শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মানবতার সেবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। এটি শেখায় যে জীবনের লক্ষ্য শুধুমাত্র নিজের কল্যাণ নয়, বরং সমাজের এবং সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা।

আধুনিক শিক্ষা


অন্যদিকে, আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন এবং অন্যান্য পার্থিব জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আধুনিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হলো কর্মজীবনে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা।

আধুনিক শিক্ষা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা বাড়ায় এবং তাকে নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। এটি মানুষকে বিশ্বকে ভিন্নভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে এবং সৃজনশীল চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র।

এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ আধুনিক প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন নতুন উদ্ভাবনের সাথে পরিচিত হয়। এটি বিশ্বায়নের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। আধুনিক শিক্ষার ফলে সমাজে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গতিশীলতা আসে।

ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার মধ্যে পার্থক্য


ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার মধ্যে লক্ষ্য ও পদ্ধতির দিক থেকে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ইসলামিক শিক্ষা আল্লাহ ও পরকালের সন্তুষ্টির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, যেখানে আধুনিক শিক্ষা পৃথিবীর ব্যবহারিক এবং বস্তুগত দিকগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়।

ইসলামিক শিক্ষা জীবনের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিকগুলোর বিকাশ ঘটায়। এটি মানুষকে আত্মশুদ্ধির পথে পরিচালিত করে এবং তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে আল্লাহর বিধানের প্রতি অনুগত হতে শেখায়।

অপরদিকে, আধুনিক শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিশ্চিত করে। এটি মানুষকে বর্তমান জীবনের চাহিদাগুলো পূরণের জন্য প্রস্তুত করে এবং কর্মজীবনে সফল হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

তবে উভয়ের মধ্যে একটি মৌলিক মিল রয়েছে। উভয় শিক্ষারই মূল উদ্দেশ্য হল মানব কল্যাণ। ইসলামিক শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়ে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে, আর আধুনিক শিক্ষা মানুষকে দক্ষ করে তোলে এবং উন্নত সমাজ গঠনে সহায়তা করে।

ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় প্রয়োজনীয়তা


বর্তমান যুগে ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় অপরিহার্য। শুধু ইসলামিক শিক্ষা বা আধুনিক শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল হওয়া মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে যথেষ্ট নয়।

ধর্মীয় নৈতিকতার ভিত্তি ছাড়া আধুনিক শিক্ষা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক ও বস্তুবাদী করে তুলতে পারে। অপরদিকে, আধুনিক শিক্ষার জ্ঞান ছাড়া একজন মানুষ বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না।

একটি ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার মিশ্রণ প্রয়োজন। ধর্মীয় জ্ঞান একজন শিক্ষার্থীকে সৎ ও নীতিবান করে তোলে, আর আধুনিক শিক্ষা তাকে দক্ষ ও কর্মক্ষম করে তোলে। এই সমন্বয়ের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।

উপসংহার


ইসলামিক শিক্ষা এবং আধুনিক শিক্ষা উভয়েরই নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে। ইসলামিক শিক্ষা আমাদের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তি স্থাপন করে। অন্যদিকে, আধুনিক শিক্ষা আমাদের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করে এবং সমাজে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক উন্নয়ন ঘটায়।

উভয়ের সমন্বয়ে একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব, যা মানুষের ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং সামগ্রিক সমাজের কল্যাণে সহায়ক হবে। আল্লাহ আমাদের এমন জ্ঞান দান করুন, যা আমাদের জীবনে দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। ইসলামিক ও আধুনিক শিক্ষার এই মিশ্রণ একটি উন্নত, ন্যায়পরায়ণ ও সুখী সমাজ গঠনের ভিত্তি স্থাপন করবে


  • হাফিজ মাওলানা ফখর উদ্দিন


[সিলেট ভয়েস-এ প্রকাশিত অভিমত, মতামত, কলাম ও চিঠিপত্র একান্তই লেখকের নিজস্ব। এতে প্রকাশিত মন্তব্য, বিশ্লেষণ বা বক্তব্য সিলেট ভয়েস-এর অবস্থান, নীতিমালা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে। লেখকের উপস্থাপিত তথ্য বা বক্তব্যের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজের।]




শেয়ার করুনঃ