শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
বহুমুখী সংকটে ব্যাহত সেবা, এক্স-রে করতে যেতে হয় জেলা শহরে
যাপিতজীবন
প্রকাশঃ ১৯ নভেম্বর ২০২৫
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার দুই লাখেরও বেশি মানুষের চিকিৎসার প্রধান ভরসাস্থল ‘শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। ২০২১ সালে যাত্রা শুরু হওয়া ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে প্রতিদিন সেবা নেন অন্তত দুই শতাধিক রোগী। কিন্তু চিকিৎসক সংকট ও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এই হাসপাতালটি। এছাড়া ওষুধ সংকট ও এক্স-রে মেশিন না থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় রোগীদের। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে ভোগান্তির সঙ্গে গুণতে হয় বাড়তি টাকা। এমন ভোগান্তি ও হয়রানীর মাত্রা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। হাসপাতালের বহুমুখী সংকট ও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব
ফুটবল খেলতে গিয়ে ডান হাতের বাহুতে গুরুতর আঘাত পান শান্তিগঞ্জের পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের বড়মোহা এলাকার কিশোর ফাহিম মিয়া (১৪)। চিকিৎসা সেবা নিতে মাকে সঙ্গে নিয়ে ফাহিম আসেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আঘাত গুরুতর অনুধাবন করে কর্তব্যরত চিকিৎসক আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা এক্স-রে করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালে এক্স-রে মেশিন না থাকায় বাধ্য হয়ে যেতে হয় সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে। এতে করে একদিকে যেমন চিকিৎসা সেবা পেতে বিলম্ব হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়তি টাকাও গুণতে হচ্ছে তাকে। শুধু ফাহিম মিয়াই নয় এক্স-রে মেশিনের অভাবে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা নিতে আসা এমন অসংখ্য রোগীকে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। এছাড়া ঔষধের ঘাটতি, চিকিৎসকসহ পর্যাপ্ত জনবল সংকট ও সার্জন না থাকায় অপারেশন থিয়েটার চালু না হওয়াসহ বহুমুখী সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। আর এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটছে শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশপাশের এলাকায়। সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশ ঘেঁষার কারণে দুর্ঘটনায় কবলিত হতাহতদের উদ্ধার করে পাঠানো হয় এই চিকিৎসাকেন্দ্রে। এসব রোগীদের প্রথমেই পাঠানো হয় জরুরী বিভাগে।
কিন্তু জরুরী বিভাগে দুইজন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকার কথা থাকলেও না থাকায় ব্যহত হচ্ছে সেবা। এছাড়া অস্ত্রোপচারে বিশেষজ্ঞ সার্জন না থাকায় অপারেশন থিয়েটার (ওটি) চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। নেই এক্স-রে মেশিনও। ফলে দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে আসা রোগীদের পুর্ণাঙ্গ চিকিৎসা প্রদান না করেই পাঠাতে হচ্ছে জেলা সদর কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে।
এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন রোগীরা। এ অবস্থায় সাধারণ রোগীরা একদিকে যেমন চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে দুরবর্তী হাসপাতালে ‘রেফার্ড’ করায় বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে সুনামগঞ্জের ৩১ শয্যাবিশিষ্ট জামালগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমএসআর বাজেট ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও এর বিপরীতে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমএসআর বাজেটের বরাদ্দের পরিমান ছিল মাত্র ৫০ লক্ষ টাকা। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প। স্বল্প এই বরাদ্দ দিয়েই ঔষধ সরবরাহসহ সকল চাহিদা পুরণ করতে হয় হাসপাতালটির। ফলে স্বল্প বরাদ্দে অধিক চাহিদা পুরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এছাড়া উপজেলার প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্রটিতে প্রতিদিন দুই থেকে তিন শতাধিক রোগী সেবা নিতে এলেও এর বিপরীতে আছেন মাত্র ৫ জন চিকিৎসক। ফলে বিপুল সংখ্যক রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় কর্তব্যরত চিকিৎসকদের। এছাড়া নৈশপ্রহরী না থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে হাসপাতালটি। একাধিকবার ঘটেছে চুরির ঘটনাও।
পশ্চিম পাগলার ইনাতনগর গ্রামের সালমা বেগম বলেন, ‘আমার বাচ্চাদের ঠান্ডাজনিত রোগের সেবা নিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলাম। ডাক্তাররা প্রায় সব ঔষধই বাইরে থেকে কিনে আনতে বলেন। হাসপাতালের ঔষধ কেন দেওয়া হয় না জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন স্টোকে ঔষধ নাই। এরকম কয়েকবার হয়েছে।’
পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের শফিকুল হক জানান, ‘রাতে বুকে গুরুতর ব্যথা নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে জরুরী বিভাগে লোক না থাকায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এভাবে চলতে থাকলে তো হবে না।’
শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হাছান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে বার্ষিক এমএসআর বাজেটের পরিমান প্বার্শবর্তী হাসপাতালগুলোর তুলনায় খুবই স্বল্প। এই স্বল্প বাজেটে পর্যাপ্ত ঔষধসহ অন্যান্য সেবা দেওয়া খুবই কঠিন। এতে অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই ঔষধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শেষ হয়ে যায়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সিভিল সার্জন মহোদয়, বিভাগীয় পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। অধিদপ্তর থেকে আমাকে জানানো হয়েছে ডিসেম্বর পরে অতিরিক্ত বাজেট দেওয়া হবে।’
চিকিৎসক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ৪ জন মেডিকেল অফিসার আছেন এবং আরএমও সাহেব দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়েছিলেন কিন্তু টানা দুই মাস ধরে তিনি অনুপস্থিত। সম্প্রতি ৪৮তম বিসিএসের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি আশা করছি শীঘ্রই সেখান থেকে আমরা চিকিৎসক পাবো। এতে সেবার মান আরো বাড়বে।‘
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন শরীফি বলেন, ‘শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স একটি নতুন চিকিৎসাকেন্দ্র। এসব হাসপাতালে বরাদ্দ দেওয়া হয় রোগীর পরিমান অনুযায়ী। নতুন হাসপাতাল হওয়ায় গত বছর মাত্র ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এবছর সেটা বেড়ে ৫০ লাখ হয়েছে। এভাবে রোগী বাড়ার সাথে সাথে বরাদ্দও বাড়ানো হবে। এসব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর এক্স-রে মেশিন শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। সেটাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো হয়। তবে এখন এই কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমরা এক্স-রে মেশিন পাচ্ছি না। তবে আগামী বছরের শুরুর দিকে সেটাও পেয়ে যাবো আশা করছি।’
চিকিৎসক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট জাতীয় সমস্যা। সারা দেশেই এই সমস্যা রয়েছে। আমরা আমাদের চাহিদা পাঠিয়ে দিয়েছি। আগামী বছর নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে। সেখান থেকে আশা করছি আমরাও আমাদের চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক পাবো।’
সুনামগঞ্জ, শান্তিগঞ্জ, স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স