ঘোষণাটা যদি এমন হতো। আমরা ক্ষমতায় গেলে নারীদের ঘরের কাজের কর্মঘন্টা কমানো হবে। পাশাপাশি পুরুষরা নিজের ও ঘরের পর্যাপ্ত কাজ করলে সম্মাননা দেবে সরকার।  তাহলে মনে হতো তাদের পূর্ব ধ্যান ধারনার পরিবর্তন হয়েছে। 


কিন্তু যা বুঝলাম কিছুই পরিবর্তন হয়নি। বিশেষ করে নারীদের বিষয়ে পুরোই অপরিবর্তনশীল। যুগ যুগ ধরে নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার যে সংস্কৃতি চলমান রয়েছে সেটাকে ভিন্ন আঙ্গিকে এনে তাদের এজেন্ডা আরও পাকাপোক্ত করার চেষ্টা চলছে এখন। 


যে নারীরা ঘরের বাইরে অফিস,  আদালত, হাসপাতাল বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মঘন্টা কখনো তাদের জন্য বাঁধা বা সমস্যার কোনো কারণ না। কর্মঘন্টাই যদি তাদের পেশাগত জীবনের অন্তরায় হতো তাহলে নারীরা কর্মঘন্টা কমানোর দাবী আরও আগেই তুলতেন। কর্মক্ষেত্রে নারীরা সবসময় যে দাবীগুলো তোলেন তারমধ্যে অন্যতম হল সমান পারিশ্রমিক, ভালো ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং সম্মান। যদি কর্মঘন্টা কমানোর কথা না বলে অন্তত এটা বলতেন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে  উন্নতমানের ডে-কেয়ার সেন্টার করা হবে। এর খরচ মালিকপক্ষ ভর্তুকি দেবে। তাহলে অন্তত কর্মজীবী মায়েরা স্বস্তি পেতেন। নিজের ছোট্ট বাচ্চাকে কাছে রাখার সুযোগ পেতেন।  


একবার ভেবে দেখেন, আপনার এই ঘোষণা যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে কর্মজীবী নারীদের উপর এর কত নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনিতে শতবার যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে চাকরী পেতে হয়। তার উপর আপনি যখন নারীদের কর্মঘন্টা কমাবেন, তখনতো আর কোনো প্রতিষ্ঠান নারীদের কাজে রাখবে না। কারণ কেউ তার প্রতিষ্ঠানে লোকসান করতে চাইবে না। আপনার ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে দেখা যাবে দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দেবে, 'নারীদের কর্ম খালি নেই' অথবা 'এই প্রতিষ্ঠানে নারীদের জন্য কোনো পদ নেই'।  অনেকে চাকরির বিজ্ঞাপনে লিখবে 'নারী হলে আবেদনের প্রয়োজন নেই'। 


আচ্ছা, আপনি যে কর্মজীবী নারীদের কর্মঘন্টা কমাবেন সেই তালিকায় কী গৃহকর্মীদের রাখতে পারবেন? যে গৃহকর্মী একটি বাসায় সারাদিন বা স্থায়ী কাজ করেন তাদের কি এই কর্মঘন্টার আওতায় আনতে পারবেন। ঢালাই শ্রমিক নারীদের কি এই কর্মঘন্টার আওতায় আনতে পারবেন। স্কুল শিক্ষকদের কী এই কর্মঘন্টার আওতায় আনতে পারবেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত যে নারীরা আছেন তাদেরকি এই কর্মঘন্টার আওতায় আনতে পারবেন। পোশাক শ্রমিকদের এই কর্মঘন্টার আওতায় আনতে পারবেন। পারবেন না। কারণ এসব সেক্টরে নারীদের কর্মঘন্টা কমালে দেশে অস্থিতিশীল তৈরি হবে। 


আমি মনে করি নারীদের পেশাগত জীবনে  প্রধান অন্তরায় হলো ঘরের কাজ। কারণ একজন নারী যত বড় পদধারী কর্মকর্তা হোন না কেন ঘরের কাজে তার কোনো মাফ নেই। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে যেমন ঘরের পরিবারের সদস্যদের সব কাজ করতে হয়, তেমনি পেশাগত কাজ সেরে ঘরে ফিরে আবার সবধরনের ঘরের কাজ করতে হয়। যার জন্য কর্মজীবী নারীরা হাঁপিয়ে উঠেন। সকালের নাস্তা বানানো,  খাওয়ানো, দুপুরে খাবার রান্না করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা করে কাজে যেতে হয় নারীদের।  আবার কাজ শেষে বাড়ি ফিরেই বিকালের নাস্তা, রাতের খাবার তৈরি করে খাওয়ানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা করো। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক ঘরোয়া কাজ নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা আছে। 


এই ঘরের কাজগুলো পুরুষরা একটু ভাগাভাগি করে  নিতো তাহলে নারীরা ঘরে বাইরে কাজ করে হাঁপিয়ে উঠতো না। নিজের জন্য একটু সময় বের করতে পারতো। কিন্তু এ নিয়ে কেউ কথা বলবে না।  কারণ ঘরের কাজেও আমরা জেন্ডারিজম করি। 


দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাদেরকে ঘরে রেখে সরকারি সম্মাননা দিয়ে হয়তো আপনি বড় ধরনের রক্ষণশীলতার নজির সৃষ্টি করতে পারবেন। কিন্তু দেশের এই বড়  জনগোষ্ঠীকে ঘরে বসিয়ে রাখলে দেশের অর্থনীতির কি বেহাল দশা হবে সেটা কী ভেবে দেখেছেন। কারণ দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরানো বড় বড় প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকই বেশি। এছাড়া পারিবারিক সহিংসতাসহ অন্যান্য বিষয় বাদই দিলাম। 


তার চেয়ে বরং যারা বাইরে কাজ করতে চায় তাদের নিরাপত্তা দিন, নারী পুরুষের বেতন বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেন। নারীদের যোগ্যতাকে সম্মান করেন। আর যারা ঘরে থাকতে চায় তাদের গৃহকর্মী না বানিয়ে সম্মানের সাথে ঘরে থাকতে দেন।


  • লেখক:  সাংবাদিক


[সিলেট ভয়েস-এ প্রকাশিত অভিমত, মতামত, কলাম ও চিঠিপত্র একান্তই লেখকের নিজস্ব। এতে প্রকাশিত মন্তব্য, বিশ্লেষণ বা বক্তব্য সিলেট ভয়েস-এর অবস্থান, নীতিমালা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে। লেখকের উপস্থাপিত তথ্য বা বক্তব্যের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজের।]


শেয়ার করুনঃ