আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী
ব্যাটারি রিকশা: নগর জীবনের অদৃশ্য মৃত্যুঘণ্টা
ইকবাল কাগজী ও সাইফুল আলম ছদরুল
প্রকাশঃ ২৬ আগস্ট, ২০২৫ ৫:০১ পূর্বাহ্ন
কয়েক শত বছরের পুরনো ‘বারকি নাও’ তার উদ্ভবের পর কালক্রমে সুনামগঞ্জসহ বৃহত্তর সিলেটের সুবিধাবঞ্চিত নিম্নবৃত্ত, এই যাকে বলে গরিব, মানুষের জীবনজীবিকা নির্বাহের একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এইসব হতদরিদ্র মানুষেরা ‘বারকিওয়ালা’ (বারকিশ্রমিক) নামে বিশেষভাবে পরিচিত, তাঁরা সুনামগঞ্জ সিলেটের বালুপাথর মহালগুলোর বালু ও পাথর আহরণ/উত্তোলনের কাজ করেজীবননির্বাহ করে থাকেন। বিগত কয়েক দশক ধরে প্রকৃতিবান্ধব সনাতন পদ্ধতিতে বালু পাথর আহরণের কাজের ক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রের (বাল্কহেড নৌকা, ড্রেজার, বোমা মেশিন বিভিন্ন নামের খননযন্ত্র ইত্যাদি) প্রযুক্ত হয়ে আহরণ কাজটিকেউত্তোলন কাজের মর্যাদায় পর্যবসিত করে প্রকৃতিবিনাশীতাকে অনিবার্য করে তুলেছে।প্রকারান্তরে হাজার হাজার বারকিশ্রমিক ও মুষ্ঠিমেয় বালুপাথরখেকো মাফিয়াচক্রের দ্বন্দ্ব-সংঘাত তীব্রতা পেয়েছে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার উৎসারণ ঘটেই চলেছে। বারকিশ্রমিক ও বালুখেকো মাফিয়াচক্রের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত ও আবর্তিত ঘটনা বিভিন্ন বাঁক ঘুরেবর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সাদা পাথর চুরির ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি তোলপাড় করা সময় অতিক্রম করছে।এইসব ঐতিহাসিক ঘটনার উৎসারণের সঙ্গে বারকি নাওয়েরঅনিবার্য আবির্ভাব, বারকিশ্রমিকগোষ্ঠীর উদ্ভবসহ সিলেট-সুনামগঞ্জসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে এবং এই সম্পর্কটি এমনি এমনি আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরে পড়ে নি। তার আছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা কিংবা বিনাশের সঙ্গে ওতপ্রোত একটি আর্থনীতিক ও ভূতাত্ত্বিক সম্পর্ক। এই ভূতাত্ত্বিক সম্পর্কটিকে উপেক্ষা করে যখন তখন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার নামে বালুপাথর মহালগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া কিংবা উন্নয়নের দোহাই দিয়ে ইজারা দিয়ে যেনতেনপ্রকারেণ বালুপাথর উত্তোলনের প্রক্রিয়া চালানো বিজ্ঞানের জ্ঞান উপেক্ষা করে বিপন্নতাকে আমন্ত্রণ করার নামান্তর মাত্র। সিলেট অঞ্চলের ১৭টি বালুপাথর মহালে এই অপরিণামদর্র্শিতার চর্চা বন্ধ করতে হবে। এইসব চিন্তায় আলোড়িত হয়ে একজন রাশেদ হাসান আকাশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন :
“ভারতের মেঘালয় মালভূমি (Meghalaya plateau)মূলত গ্রানাইট ও নাইস-এর মতো কঠিন শিলা দ্বার ঘটিত। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বৃষ্টি, বাতাস এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে এই শক্ত শিলাগুলো ক্ষয় হতে থাকে। এই প্রক্রিয়াতে শিলা থেকে কোয়ার্টজের মতো কঠিন খনিগুলো আলাদা হয়ে নুড়িতে পরিণত হয়। বর্য়াকালে বা পাহাড়ি ঢলের সময়, খরস্রােতা পাহাড়ি নদীগুলো (যেমন পিয়াইন ও ধলাই)শক্তি নিয়ে নেমে আসে। এই প্রবল স্রােত তখন ক্ষয়প্রাপ্ত নুড়ি, বালি ও পাথরগুলোকে ঠেলে বাঙরাদেশের দিকে নিয়ে আসে। নদীগুলো যখন মেঘালয়ের খাড়া ঢাল বেয়ে বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে প্রবেশ করে, তখন এদের গতি হঠাৎ করে কমে যায়। ফলে, নদীগুলো আর ভারী পাথর ও নুড়িগুলোকে বহন করতে পারে না। তখন এই পাথরগুলো নদীর বাঁকে বা চরে জমা হতে থাকে। ভোলাগঞ্জ ও জাফলং এমনই দুটি স্থান। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে ভূতত্ত্বের ভাষায় প্লাসার ডিপোজিট (placer deposit) বলা হয়। এখানে যেহেতু আমরা জানি এই পাথরগুলো একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সীমান্তে এসে জমা হয়, সেহেতু আমাদের পরবর্তী বিষয়গুলো হলো সম্পদের পরিমাণ (estimated resources) খনির প্রকৃতি (nature of deposit)। এই পাথরগুলো কোনও সুরঙ্গ বা গভীর গর্ত খুড়ে তৈরি করা খনি থেকে তোলা হয় না। এগুলো সরাসরি নদীর তলদেশ এবং নদীর তীরে জেগে ওঠা চর থেকে সংগ্রহ করা হয়। তাই এ খনির প্রকৃতি হলো উন্মুক্ত বা সারফেস ডিপোজিট (open/surface deposit)।
ভূতাত্ত্বিক ভাষায় একে প্লাসার ডিপোজিট (placer deposit) বা এলোভিয়াল ডিপোজিট (alluvial deposit) বলে, যেখানে মূল্যবান খনিজ (এখানে পাথর) নদীর স্রােতের মাধ্যমে এক জায়গায় জমা হয়।” এইটুকু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কল্যাণে যে-কেউ কোনও ক্ষমতাধর পরিবেশকর্মী, কোনও উপদেষ্টা কিংবা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রকের প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করতেই পারেন যে, বালু-পাথর উত্তোলন কিংবা উত্তোলন বন্ধ করার বিষয়ের মতো এতো বড় গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে নদী, পর্যটন, ভূতাত্ত্বিক, খনিজসম্পদ, বন পরিবেশ বিষয়ক গষেকদের সমন্বয়ে গবেষণার পর তাদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতো, কিন্তু নেওয়া হয় নি। আসলে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বালু-পাথর উত্তোলনের বিষয়টি একটি অপিরিণামদর্শী কার্যক্রমে পর্যবসিত হয়েছে, যা দেশের আর্থামাজিক ব্যবস্থায় একটি হ-য-ব-র-ল পরিসর তৈরি করেছে।
তাই দেশের বর্তমান আর্থনীতিক পরিসরে বারকি নাওয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় আর্থনীতিক সম্পর্কের একটি পরিণামদর্শী চিত্র সন্নিবেশন করা বোধ করি অসঙ্গত বলে বিবেচিত হবে না। এ জন্যে প্রথমেই বর্তমানে কী হচ্ছে তার একটি চলনসই বিবরণ চাই। এখন অবস্থা এমন যে, নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের দেশে দেশশুদ্ধ সব কীছুই লুট হয়ে যাচ্ছে। সাদা পাথরও লুট হয়ে গেছে। এখানে এটাই বরং স্বাভাবিক। এই লুট হওয়াটা রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যক্রমের প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব হলো তার প্রতিকার। আর প্রতিকার মানে হলো ব্যতিক্রম বাদে ধামাচাপা দেওয়ার একটি সরকারি ব্যবস্থা কিংবা কার্যক্রম পরিচালনা। কথায় আছে ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। পাথর চুরির পর প্রশাসনও সক্রিয় হলো। বলা ভালো, সক্রিয় হতে বাধ্য হলো। একেই বলে ঠেলার চোটে বদনা ফাটে। চতুর্দিকে হুলুস্থুল। রাস্তায় বিক্ষুব্ধ নাগরিকদের মানববন্ধন একের পর এক। অভিযোগের আঙুল প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দিকে। অভিযানে নামলেন প্রশাসনের প্রতিনিধিরা। তাঁদের নজরে এলো জাফলং পাথর মহালের ঘাটে বাঁধা কাঠের তৈরি সারিবদ্ধ বারকি নাও এবং যথারীতি বারকি ধ্বংসের আদেশ নাজিল হল, সঙ্গীয় আনসার হেমার দিয়ে আঘাত করে করে বারকি ভেঙে দিয়ে সাদা পাথর লুটের সরকার নির্ধারিত ‘যথার্থ প্রতিকার’ করাতে কোনও কার্পণ্য করা হলো না, যদিও তাতে পাথর লুটের মূল হোতাদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করা থেকে আভিযানিক দল দূরেই রইলেন। এদিকে অসহায় বারকি-শ্রমিকরা দূর থেকে করুণ নয়নে নিজেদের সাড়ে সর্বনাশ প্রত্যক্ষ করছিলেন। ভাঙা বাতা-গলুই ও তলা ফুটো নাওয়ের ছিদ্র দিয়ে পানি উঠছে, চোখের সামনে ধ্বংস হচ্ছে তাঁদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। শত সমালোচনার পরেও বার বার এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে অর্থাৎ বরাকি ভাঙার মচ্ছবে মেতে উঠে সরকারি আভিযানিক কর্তব্য সম্পন্ন করা হয়েছে। ২৭ ও ৩১ জুলাইয়ের পরে ১৩ ও ১৭ আগস্টে পরিচালিত আভিযানিক দল বারকিদলনে কোনও কার্পণ্য করেন নি। এই ৪ দিনে তাঁরা ১৭০টি বারকি ভাঙার কৃতিত্ব প্রদর্শনের শিরোপা অর্জন করলেও পাথর লুটেরা মাপিয়াচক্রের কেশাগ্রও স্পর্শ করার শিরোপা অর্জনে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন।
এই ব্যর্থতার করুণ চিত্র পাওয়া যায় একজনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেবাকবিস্তারের কল্যাণে। খালেদ মহিউদ্দিন একজন আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত সংবাদকর্মী। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, “... কোম্পানিগঞ্জের পথে পথে অগনিত পাথর কোয়ারির কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে, একসময়ের প্রাণচঞ্চল জনপথের প্রতিটা বাজার একাকীত্ব নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে, এলাকা কর্মক্ষম পুরুষশূন্য হয়ে গেছে। একটা অর্থনৈতিক কর্মাঞ্চল যে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে তা তারা দেখতে পাননি।” এইটুকু বাক্যবিবরণ থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, এখানে পাথর লুটের কথাই বলা হয়েছে, যার পরিণতিতে একসময়ের ব্যবসাবাণিজ্যের রমরমা অবস্থা পেরিয়ে বর্তমানে ‘এলাকা কর্মক্ষম পুরুষশূন্য হয়ে গেছে’ বলতে বালুপাথর আহরণ/উত্তোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী (বিশেষ করে বারকিশ্রমিক ও তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনেরা) বেকার হয়ে পড়ে, জীবনজুড়া বিপাকে পড়েছেন, কাজের সন্ধানে সপরিবারে অন্যত্র উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়েছেন এবং যথারীতি বালুপাথর মহালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা পূর্বেকার জমাটি অবস্থা এখন আর নেই। এই পাথর লুটের ঐতিহাসিক কা- নিয়ে সম্প্রতি তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশে। দেশের আদালত, অন্তর্বর্তী সরকার ও উপদেষ্টারা আন্দোলিত হয়েছেন। আদালত চুরি করা সাদা পাথর উদ্ধার করে যে-স্থানে পাথর ছিল সেই স্থানে রেখে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং প্রশাসন অভিযানে বেরিয়ে পাথরখেকো মাফিয়াচক্রের সদস্যদের সন্ধানের পরিবর্তে বারকি নাও ভাঙার তুগলকি কা- করার প্রয়াসে নিমগ্ন হয়ে উদোর পি-ি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার সনাতনী কৌশল নতুন করে প্রয়োগ কারার পারঙ্গমতা প্রকাশ করছেন।
গত ৯ আগস্ট ২০২৫ দৈনিক খবরের কাগজে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল : ‘মব মচ্ছবে’ সাদা পাথরের ‘সর্বনাশ’। সচিত্র সংবাদবিবরণে বলা হয়েছে, “ ... দৃশ্যটি এবারের বর্ষাকালে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র ‘সাদা পাথর’ এলাকার। ... পাথরস্তূপ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্কমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাথর লুটপাটের ঘটনাকে ‘মব মচ্ছব’ বলছেন পর্যটকরা। গত এক সপ্তাহে সরেজমিনে সেখানকার চিত্র খবরের কাগজের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। লুটপাটে দফায় দফায় সাদা পাথর এলাকার চিত্র বদলে যাচ্ছে। যেন ‘মব মচ্ছবে’ সাদা পাথরের ‘সর্বনাশ’।
সর্বশেষ শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকাল থেকে সাদা পাথর এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ফাঁড়ি এলাকা মাড়িয়ে জিরো পয়েন্ট দিয়ে পাথর লুট হচ্ছে। সরেজমিনে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে সাদা পাথর এলাকায় কয়েক দফা পাহাড়ি ঢল নামে। প্রতিবারই ঢলের তোড়ে স্তরে স্তরে পাথর ও বালু নামে। এবার দফায় দফায় ঢলের পর শুধু বালু দেখা গেছে। বালুর স্তর সরিয়ে পাথর লুটপাট হয়েছে। স্থানীয় লোকজন বলছেন, দুই সপ্তাহে অন্তত শতকোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।” এই একই পত্রিকার ১৮ আগস্টের মুদ্রিত সংস্করণে পাথরলুটসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “এবার রাংপানির ‘রাঙা’ পাথর লুট!”। উজ্জ্বল মেহেদী ও শাকিলা ববি, সরেজমিন ঘুরে প্রতিবেদন করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “এবার পাহাড়ের ঢাল কেটে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুরের শ্রীপুর রাংপানি এলাকায় আরেক ধরনের পাথর লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। এই পাথরের আকার-আকৃতি-রং আলাদা। পাথরগুলো দেখতে লালচে ও রাঙা। স্থানীয়রা বলেন ‘রাঙা’ পাথর। এই পাথর আকৃতিতে বড় হওয়ায় সরাসরি নৌকায় বহন করা যায় না। হাতুড়ি দিয়ে রাংপানি স্পটেই ছোট টুকরো করে ভেঙে নৌকায় করে নিয়ে যেতে হয়। রাংপানি জিরো পয়েন্টে শত শত শ্রমিক একদিকে পাথর ভেঙে নৌকায় তুলে নিয়ে যান, অন্যদিকে নৌকা দিয়ে বিজিবি টহল দেয়। এই দৃশ্য দেখে যে কারও মনে হতে পারে, কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে লুট হচ্ছে পাথর। রবিবার (১৮ আগস্ট) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শ্রীপুরের রাংপানি এলাকায় একদিকে পাথর লুট আর অন্যদিকে বিজিবির সহাবস্থান দেখা গেছে। তবে বিজিবি বলছে, শ্রীপুরের রাংপানির যে জায়গায় পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে, সেটা সীমান্তের জিরো লাইন। তাই চাইলেও এই জিরো লাইন অতিক্রম করতে পারে না বিজিবি।” বিশেষ পরিতাপের বিষয় যে, প্রতিবেদনে ‘কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে লুট হচ্ছে পাথর’ এইরূপ বাক্য পাঠ করতে হচ্ছে পাঠককে। অবস্থা বিবেচনায় বাক্যটিকে প্রতিবেদকদ্বয় ‘কঠোর প্রশাসনিক নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে লুট হচ্ছে পাথর’ লিখতেই পারতেন, কিন্তু লিখেন নি, লিখলে অবাক করা বৈচিত্র্যটা ধরা পড়তো। অবস্থা বিশেষে তাই আলেক্সজা-ারের মতো বলতেই হচ্ছে, ‘কী বিচিত্র এই দেশ! সিলোকাস।’
অতিসম্প্রতি এরকম বেশকিছু সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের পাতায় একের পর পর এক ফলাও করে ছাপা হয়েছে। এইসব সংবাদ প্রমাণ করেছে যে, সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষায় রাষ্ট্রপক্ষ একেবারেই নির্বিকার। তেকারণে গত ক’দিন আগে (১৪ আগস্ট ২০২৫) সাদাপাথর লুট প্রসঙ্গে ক্ষোভের আগুনে পোড়া অগণিত চমৎকার মন্তব্য ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। একজন সাইদ ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যে সময় পাথর নিয়েছিল ওই সময় কোথায় ছিলেন। পাথর নেওয়া শেষ, এখন লোকদেখানোর জন্য গরীবের নৌকা ভাংচুর করছেন। এই নাটক বন্ধ করেন।’ এখানে আমজনতার একজনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষকে সরাসারি দায়িত্বে অবহেলার দায়ে দায়ী করা এবং আসল অপরাধীকে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার রাষ্ট্রীয়নীতির নির্লজ্জ চর্চাকে (কার্যত যে-চর্চা প্রশাসন প্রতিনিয়ত করে চলেছে) সমালোচনা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সরাসারি দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে ২১ আগস্ট ২০২৫-য়ে পেশকৃত দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে। এই সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে দৈনিক যুগান্তরের মুদ্রিত সংস্করণে প্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে ‘দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান : প্রশাসন রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ী মিলেমিশে সাদা পাথর লুট’।
সংবাদবিবরণীতে লেখা হয়েছে, “সিলেটের সাদা পাথর লুটের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এলাকা থেকে কয়েকশ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধাভোগী হিসাবে খনিজসম্পদ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিগত ১ বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করা ৪ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ ও বিজিবির নাম উঠে এসেছে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে প্রশাসনের লোকজন ছাড়াও পাথর লুটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, এনসিপিসহ ৪২ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যুগান্তরের হাতে আসা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অসাধু চক্রের যোগসাজশে এই ঘটনা ঘটেছে।” তারও আগে ১৭ আগস্ট গণমাধ্যমে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, “সরকারের কাজ নীতিমালা প্রণয়ন করা, আমরা কিন্তু সেই নীতিটি ঠিকই প্রণয়ন করেছি- যে এই ১৭টিতে পাথর উত্তোলন করা যাবে না। পাথর আদৌ উত্তোলন হচ্ছে কি না এটি দেখবে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন। আমরা কিন্তু বারবার প্রশাসনকে বলেছি, লিখেছি। আমি যখন দেখলাম প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না, তাদের সাহস দেওয়ার জন্য আমি এবং ফাওজুল ভাই (উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান) দুজনই ফিল্ডে গেলাম। যখন আমরা ফেরত আসলাম তখন আমাদের গাড়ি ঘিরে যে অশ্লীল বিক্ষোভ প্রদর্শন করলো এবং পরে সেই বিক্ষোভের জের ধরে একটি রাজনৈতিক দল নেতাদের বহিষ্কার এবং সাসপেন্ডও করলো; সেই সময় যদি প্রতিবাদটা খুব জোরালো হতো না, তাহলে আজকের পরিস্থিতিটা ভিন্ন হতো।”
গণমাধ্যেমে প্রকাশিত এইসব প্রতিবেদনের সত্যমিথ্যার অনুপুঙ্খ বিচারবিশ্লেষণ হতেই পারে এবং হওয়া উচিত। কিন্তু যা-ই হোক না কেন সংঘটিত পাথর লুটের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতের গভীরে নিহিত এই সত্য ‘স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অসাধু চক্রের যোগসাজশে এই ঘটনা ঘটেছে।” যে-চক্রের সদস্যরা হলেন প্রতিবেদনে বলে দেওয়া ‘প্রশাসনের লোকজন ছাড়াও পাথর লুটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, এনসিপিসহ ৪২ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী’রা। এই সত্যটিকে আড়াল করা যায় না কীছুতেই, কোনও যুক্তিতেই। যদি আড়াল করার চেষ্টা করা হয়, তবে সেটা হবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো একটি উদ্দেশ্যপ্রণেণাদিত প্রয়াস এবং যে-প্রয়াসটিকে নির্দ্বিধায় অপপ্রয়াস বলে অভিহিত করা যাবে।
পাথরলুটের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তবতার সার্বিক বিচারবিশ্লেষণের সুবাদে অনায়াসে প্রতিপন্ন হয় যে, রাষ্ট্র প্রভুত অবৈধ সম্পদের মালিক মাফিয়াচক্রের নিয়োজিত সেবক, শোষিত ও নিপীড়িত মেহনতি জনতার কেউ নয়, রাষ্ট্র মূলত ব্যক্তিগত মালিকানার পাহারাদার মুনাফালোভী মুক্তবাজার অর্থনীতির ফেরিওয়ালা মাত্র। এইরূপ রাষ্ট্রীয় আচরণ নিয়ে একটু বাঁকা করে ভাবলে এর আর একটি অর্থ এই হয়ে পড়ে যে, রাষ্ট্র একটি সম্পদ লুটপাটের উত্তম যন্ত্র। জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জনগণের সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের রাজনীতিক সংগঠন নয়। রাজনীতির এইরূপ নেতিবাচকতাকে প্রকাশ করতে গিয়েই বোধ করি একজন রাষ্ট্রচিন্তক বলেছেন, “প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে শোষক রাষ্ট্র সত্যিই সমগ্র সমাজের স্বার্থ প্রকাশ করছে, সবার কাছে দৃশ্যমান একটা সংগঠনে মিলিত করেছে সমাজের সমস্ত সদস্যদের। তবে এমন কোনো রাষ্ট্র ছিল না এবং নেই যা শোষক এবং শোষিত উভয়ের স্বার্থই প্রকাশ করেছে সমমাত্রায়। যেসব দেশে স্বল্পাংশের হাতে জাতীয় সম্পদের মূলভাগটা কেন্দ্রিভূত, রাষ্ট্র সেখানে সবার স্বার্থের রক্ষক নয়, সর্বাগ্রে তা অধিকাংশের পীড়ক। এই মূলকথাটাতেই উদঘাটিত হয় রাষ্ট্রের মর্মার্থ বা তার শ্রেণিগত চরিত্র, রাষ্ট্রিক ক্রিয়াকলাপের সত্যিকার অর্থ বোঝা সম্ভব হয় তাতে।” [গেন্নাদি বেলভ, রাষ্ট্র কী, অনুবাদ : ননী ভৌমিক, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা : ২১।] অপরদিকে সাইদ ফখরুল ইসলাম যখন বলেন, ‘যে সময় পাথর নিয়েছিল ওই সময় কোথায় ছিলেন।’ অর্থাৎ রাষ্ট্র কোথায় ছিল ? এই প্রশ্নের উত্তরে গেন্নাদির মতো বলতেই হয়, ‘রাষ্ট্র সেখানে (যেসব দেশে স্বল্পাংশের হাতে জাতীয় সম্পদের মূলভাগটা কেন্দ্রিভূত) সবার স্বার্থের রক্ষক নয়, সর্বাগ্রে তা অধিকাংশের পীড়ক’। অর্থাৎ সাদাপাথর লুটপাটের ব্যাপারে কর্তব্যপরায়ণতা প্রদর্শনের বেলায় রাষ্ট্র তার শ্রেণিগত চরিত্র বজায় রাখতে ও শ্রেণি স্বার্থ উদ্ধারের প্রশ্নে অবিচল থাকতে কসুর করে না এবং সুকৌশলে পাথর লুটপাটের মূলহোতাদের সন্ধান পরিহার করে বারকি ভাঙার কাজে পারঙ্গমতা প্রদর্শন করে। এইভাবে বালুপাথর মহাল, জলমহাল, হাওরক্ষা বাঁধ নির্মাণ, সরকারি দামে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়, বিদেশ থেকে পাথর আমদানি ইত্যাদি অন্যান্য যাবতীয় সব রাষ্টীয় কর্মকা-ের প্রত্যেকটিতে রাষ্ট্র অল্পসংখ্যক শোষক শ্রেণির (সাদা পাথর লুটের ক্ষেত্রে পাথরখেকো ধনাঢ্য মাফিয়াচক্রের) সেবকের ভূমিকা পালন করে এবংসংখ্যাধিক শোষিত শ্রেণির পীড়কে পর্যবসিত হয়ে প্রকারান্তরে সমাজের উপর একধরণের কাঠামোগত সহিংসতার বিস্তার ঘটায় এবং এতে করে জনগণের বৃহদাংশের জন্য রাষ্ট্র একটি অনিবার্য পীড়নযন্ত্র বিশেষে পর্যবসিত হচ্ছে। তাই বলি, রাষ্ট্রচিন্তক গেন্নাদির চিন্তার সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্যকারী সাইদের চিন্তা এক সমান্তরালে গিয়ে উপনীত হয় বা তাঁদের উভয়ের চিন্তার মধ্যে কোনও ফাঁরাক থাকে না। রাষ্ট্রের বর্তমান সাংগঠনিক পরিসরে যে-রাজনীতিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসম্পদ বলে বিবেচিত হয়ে আসা জনগণের সম্পদ কোনও না কোনও বিশেষ কৌশলে বিশেষ করে লুটেরা ধনিক শ্রেণির হাতে তোলে দিতে পারলেই রাষ্ট্রপ্রতিনিধিগণ তাঁদের দায়িত্বের পবিত্রতা রক্ষিত হয়েছে বলে সবিশেষ কৃতার্থ বোধ করেন।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটেরা ধনিকশ্রেণি তথা মাফিয়াগোষ্ঠী সব সময়ই সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকে। ২০১৮ সাল থেকে সারা দেশে ৫১টি বালু-পাথর মহালে ইজারা স্থগিতাদেশ কার্যকর করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে (১৩ জানুয়ারি ২০২৫) সারা দেশে বালু-পাথর মহাল ইজারা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হলে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের জাফলং এবং ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকার পর্যটন রক্ষার যুক্তি উত্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট অঞ্চলের ১৭টি পাথর-বালু মহাল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সরকার পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য যে, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের জায়গার পরিমাণ মাত্র ৫ একর আর ভোলাগঞ্জ পাথর মহালের জায়গার পরিমাণ ৩০৫.৮৯ একর। কিন্তু পর্যটনবান্ধব ৫ একর বাদে এই বিশাল জায়গায় ইজারা বন্ধ থাকাবস্থায় সুরক্ষামূলক কোনও আইনি ব্যবস্থা কার্যকর ছিল না। ফলে সুযোগসন্ধানী পাথরখোকোরা রাজনীতিক প্রশ্রয়ের ছত্রছায়ায় প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আঁতাত করে অরক্ষিত পাথর লুটের মহাযজ্ঞে বিপুল বিক্রমে নিয়োজিত হয়েছে এবং অপর দিকে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন, প্রতিরোধের কোনও কার্যক্রম নেওয়া হয় নি। সিলেটে পাথর লুটের বিষয়ে দুদকের তদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে গত ২২ আগস্ট দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল, ‘দুদকের অনুসন্ধান : পাথর লুটে জড়িত ৪২ নেতা ব্যবসায়ী, ভাগ পেতেন ডিসি-এসপি’। অথচ বারকিশ্রমিকসহ সাধারণ মানুষ চাইতেন এবং চান এই মহালগুলোতে সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতিবান্ধব সনাতন পদ্ধতিতে (বালতি, বেলচ, নেট, সাবল) পাথর-বালি আহরণের সুযোগ করে দিয়ে গরিব মেহনতি মানুষের রোজিরোজগারের উপায় নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু করা হয় নি। যদিও সে ভাবনায় উজ্জিবীত হতে পারতেন সৈয়াদা রিজওয়ানা হাসান। কিন্তু জনহিতকর এমন ভাবনার বিপরীতে তিনি যা ভেবেছেন, তা শেষ পর্যন্ত লুটতন্ত্রের সহায়ক অস্ত্র হয়ে উঠেছে। পাথর উত্তোলন বন্ধের বিপরীতে রাজনীতিক দলের প্রতিনিধিরা , প্রশাসন ও ব্যবসায়ীরা একাট্টা হয়ে তাঁকে, বলা যায়, পরাস্ত করেছে। এইরূপ জটিল পরিপ্রেক্ষিতের সুবাদে তিনি পাথর লুটের দায় তাঁর কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হন। তাই যে কেউ ভাবতেই পারেন যে, উপদেষ্টা কর্তৃক পাথর উত্তোলন বন্ধের সঙ্গে পাথররক্ষার অনুকূলে পাহারার ব্যবস্থা কারার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা সঙ্গত হয় নি। পাথররক্ষার ব্যবস্থার কথা না বলে তিনি পর্যটনরক্ষার স্বার্থে বালুপাথর মহাল ইজারা স্থগিত করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং ইজারা স্থগিতের পক্ষে যুক্তি টেনে বলেছেন যে, বারকি শ্রমিকরা অমানুষিক পরিশ্রম করাসহ গর্তে পড়ে মৃত্যুবরণ করেএবং যেহেতু বিদেশ থেকে চাহিদার ৯৪ শতাংশ পাথর আমদানি করা হয়সেহেতু বাকি ৪ শতাংশ চাহিদা পুরণের জন্যে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি, তাঁর মতে, ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না, উপেক্ষা করাই যায়। এবং সব শেষে তিনি পাথর লুটের দায় এড়ানোর প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।তিনি পাথর মহাল বন্ধ করেছেন বটে, কিন্তু একবারও ভাবেননি মহাল বন্ধ হলে মহালের বালুপাথর তোলে যাঁরা জীবন চালান, পরিজন নিয়ে আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকেন, তাঁদের কী হবে, তাঁরা বেকার হয়ে পড়লে পরিবার পরিজন নিয়ে কী করে বেঁচে থাকবেন? তাঁদের জীবন রক্ষার উপায়ের কথা ছেড়ে দিয়ে তিনি পাথর উত্তোলনের কাজে তাঁদের কঠোর পরিশ্রমে পাওয়া কষ্টের কথা ভেবেছেন এবং প্রকারান্তরে কঠোর পরিশ্রম থেকে রেহাই দিতে মহাল বন্ধ করে তাঁদের রোজিরোজগারের পথ বন্ধ করে দিয়ে তাঁদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি ভুলে গেছেন যে, বারকিশ্রমিকরা বেঁচে থকার জন্যেই কঠোর পরিশ্রম করেন এবং গর্তে পড়ে মৃত্যুরভয়ে ভীত হন না। তিনি আরও একটি কথা ভুলে গেছেন, রাষ্ট্র কোনও রোজগারের উপায় রহিত করতে পারে তখনই যখন বিকল্প কোনও উপায় খোলে দিতে পারে। অন্যথায় রাষ্ট্র তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান যখন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে বন্ধ মহালগুলো খোলে দেন তখন বালুপাথরলুটেরা গোষ্ঠী সুযোগ পায়, সাদাপাথরসহ সবধরণের বালুপাথর লুট করতে মরিয়া হয়ে উঠে এবং সরকার বছরখানেক সময় নির্বিকার থেকে এই লুটপাটের বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে। এককথায় লুটেরাদের পাথর লুট করার সুযোগ প্রাপ্তির ভেতর দিয়ে আবারও প্রতিপন্ন হয় যে, রাষ্ট্র শ্রেণিস্বার্থ উদ্ধারের একটি হাতিয়ার মাত্র। সব সময়ই ক্ষমতাসীনরা এটিকে নিজের ও নিজের শ্রেণিস্বার্থেব্যবহার করেন এবং যথারীতি প্রতিপন্ন হয় মাননীয়া উপদেষ্টা এই ‘মুনাফানির্ভর’ রাষ্ট্রের ক্রিড়নক মাত্র। তিনি এমন রাষ্ট্রের মানচিত্রসীমার যেকোনও স্থানে তথাকথিত ‘অশ্লীল’ অবরোধের শিকার হতে পারেন এবং এর ভেতরে দাঁড়িয়ে তাঁর কীছু করার নেই। পাথর লুটের পর, বনলতা সেনের মতো জনগণ তাঁকে প্রশ্ন করতেই পারেন, ‘এতো দিন কোথায় ছিলেন?’
সাদা পাথর লুটের সংবাদ সম্প্রচারের বদৌলতে চারদিকে এবার একটু ব্যতিক্রমী কায়দায় হইচই উঠেছে। হাইকোর্টের একজন আইনজীবীর আবেদনে দুদকের কেন্দ্রীয় তদন্ত টিম সরাসরি সাদা পাথর এলাকায় তদন্ত করতে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁদেরকে ধন্যবাদ। নিয়মমাফিক এই তদন্ত তাঁদের নিজেদের আভ্যন্তরীণ সক্রিয়তা থেকেই উৎসারিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটা তাঁরা করেছেন একজনের আবেদনের প্রেক্ষিতে অনুপ্রাণিত হয়ে। এটাও মন্দ নয়। কারণ বিদ্যমান পরিন্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে কেউ কেউ মনে করছেন, এবারে হয়তো লুটেরা মাফিয়াচক্রের মূলহোতাদের চিহ্নিত করে জনসম্মুখে তাদের মুখোশ উন্মোচন করা সম্ভব হলেও হতে পারে। চারদিকে প্রতিবাদকারীরা সক্রিয়তা প্রদর্শন করছেন। এই সক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্য প্রতিবাদী মন্তব্য ও রাজপথে সভাসমাবেশ, মানববন্ধনের তোড়জোরের প্রাবল্য ও বাহাদুরিতে। দুদকের অনুসন্ধানী প্রয়াস প্রতিবাদকারিদের আশান্বিত ও তাঁদেরকে লুটেরা মাফিয়াচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তোলতে উজ্জীবিত করেছে। তারপরেও সরাসরি সম্প্রচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে কেউ কেউ সমালোচনার দন্তব্যাদন করে লিখেছেন, “রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার আসিলেন” এবং একজন লিখেছেন, “পাথর লুটের সময় প্রশাসন কোথায় ছিল, বসে বসে সে ফিডার খাচ্ছিল?” এরকম বিদগ্ধ মন্তব্যে সম্প্রতি সরগরম হয়ে উঠেছে আন্তর্জালের জগৎ।
দৈনিক প্রথম আলোতে বিগত ১৮ আগস্ট ২০২৫ তারিখে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বরাত দিয়ে সংবাদশিরোনাম করা হয়েছে, “সব সময় চুনোপুঁটি ধরি, রুই-কাতলা ধরা পড়ে না : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা”। সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় তিনি বলেছেন, ‘সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, নিরীহ কেউ যাতে শাস্তি না পায়। অপরাধী যাতে ছাড় না পায়। আমরা সব সময় চুনোপুঁটি ধরি। রুই-কাতলা ধরা পড়ে না। রাঘব বোয়ালদের ধরার চেষ্টা চলছে।’ তাঁর এই বক্তব্য পাথর লুটের ব্যাপার নিয়ে নয়, কিন্তু পাথর লুটের প্রতিকারে নেমে সেই একই ‘রুই-কাতলা ধরা পড়ে না’র বিষয়টির পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যা বিদ্যমান আর্থসাজিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিকই বটে। কিন্তু এর পরিবর্তন চাই। অপরাধীদের ধরা ও তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে ব্যক্তিমালিকনার লোভের আগুনে প্রতিনিয়ত নিম্নবিত্ত মেহনতি মানুষের জ¦লেপোড়ে মরার ভয়াবহতা উত্তরোত্তর বাড়বে বৈ কমবে না।কারণ এখানে সম্পদ আত্মসাৎ কিংবা লুটতন্ত্রের জায়মানতার উপর নির্ভর করে নিম্নবিত্তের মানুষের উপর উচ্চবিত্তের মানুষদের দ্বারা আরোপিত একটি আধিপত্য বিরাজ করছে। সম্পদ আত্মসাতের জায়মান এই প্রক্রিয়া চিরতরে বন্ধ করতে হলে অবশ্যই সম্পদের উপর ব্যক্তিমালিকানার নিয়মের পরিবর্তে সামাজিক মালিকনার নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। মনে রাখতে হবে, এর কেনও বিকল্প নেই, অর্থাৎ মুষ্ঠিমেয় লুটেরাশ্রেণির আধিপত্যের বিপরীতে সংখ্যাগলিষ্ঠ শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষের আধিপত্য কায়েম করতে হবে। এরপর দুর্মোখ কেউ বলতেই পারেন, ‘নয় মন ঘিও হবে না রাধাও নাচবে না’। এই প্রবাদ মেনে নিলে বলতে হবে,কেবল বালু কিংবা পাথর নয়,ব্যক্তির স্বাধীনতাসহ এই পুরো দেশটাই লুট হতে থাকবে, এমন কি উপদেষ্টার স্বাধীনতাও।