প্রণবকান্তি দেব
বইকে হৃদয়ের কাছাকাছি রাখি

নাজমুল হুদা
প্রকাশঃ ১ মে, ২০২৫ ৫:১৮ অপরাহ্ন
“চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।”
শ্রমিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে পহেলা মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। দিবসটি শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও ন্যায্য অধিকার আদায়ের ইতিহাস বহন করে। এটি কেবল একটি নির্দিষ্ট তারিখ নয়, বরং দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের প্রতীক ও অনুপ্রেরণা।
‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ছোট-বড় শহরগুলোতে আনন্দ শোভাযাত্রা, র্যালি, সভা-সমাবেশ, আলোচনা সভা, প্রতিবাদ মিছিল ইত্যাদি আয়োজন করে থাকে। হাজার-হাজার শ্রমিক বা খেটে খাওয়া মানুষের উপস্থিতিতে এসব সমাবেশ আয়োজন করা হয়ে থাকে।
তবে দিনশেষে শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যায্যতার কথা বলা মানুষের সংখ্য খুবই নগণ্য। নিজেকে উপস্থাপন করা কিংবা স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অনেকে বছরান্তে এ দিবসে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেন বা অংশ নেন, আর বছরের বাকি দিনগুলোতে শ্রমিকদের অধিকার ও ন্যায্যতা নিয়ে তাদের ন্যূনতম আলাপচারিতায়ও দেখা মিলে না।
ঐতিহাসিকভাবে দিবসটি শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পালিত হয়ে থাকে। যাদের আত্মত্যাগে শ্রমিকের কাজের সময়সীমা নির্ধারণ ও কাজের পরিবেশ তৈরিসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কেননা ১৭৬০-এর দশকে শিল্প বিপ্লব শুরুর প্রাক্কালে মানুষকে যন্ত্রের মতো ব্যবহার করা হতো, কাজের সময়সীমা ছিলো ১২-১৬ঘন্টা। ছিল না কাজের অনুকূল পরিবেশ, নামমাত্র মজুরী আর অনিরাপদ কর্মস্থল তখনকার মানুষকে জাগিয়ে তোলে। রূপ দেয় শ্রমিক আন্দোলনে।
এর প্রেক্ষিতেই ৮ঘন্টা কর্মঘন্টা নিশ্চিতসহ শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে ১৮৬১ সালে ১লা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শ্রমিকরা। আন্দোলনের এক পর্যায়ে অজ্ঞাতপরিচয় একজন বোমা নিক্ষেপ করলে, পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়, বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।
সেদিনের ভয়াবহ ঘটনাবলীর স্মরণে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেসময় থেকেই সারাবিশ্বে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
মে দিবস শুধু আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের স্মারক নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় এটি শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্য, অধিকার এবং শোষণবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। পূর্ব থেকে দিবসটি পালনের অংশ হিসেবে উপনিবেশিক শাসন ও পুঁজিবাদী শোষণের বিরূদ্ধে নিপীড়িতদের কন্ঠস্বর হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কেননা ঔপনিবেশিক শাসন ও পুঁজিবাদী শোষণের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রমিক ও কৃষক দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চনার শিকার হয়েছে। শিল্পায়নের প্রসার হলেও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বরং পদে পদে তারা মজুরি বঞ্চনা, জমির অধিকারহীনতা এবং ফসলের অবমূল্যায়নের মুখোমুখি হয়েছে।
এই বাস্তবতায় মে দিবস তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের একটি শক্তিশালী দিন হয়ে ওঠে, যেখানে শ্রমিক ও কৃষক উভয়ে তাদের সম্মিলিত দাবি যেমন ন্যায্য মজুরি, জমির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা ও শোষণমুক্ত জীবনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। এমনকি শিল্প শ্রমিক আন্দোলন, ভারতের কিষাণ আন্দোলন কিংবা নেপালের মাওবাদী সংগ্রামের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এখানে স্মর্তব্য সিলেটের বিখ্যাত নানকার বিদ্রোহ। ব্রিটিশ ভারত এবং দেশভাগ পরবর্তী সময়ে জমিদারের অধীনে ভূমিদাস প্রথা বা ‘নানকার প্রথা’ প্রচলিত ছিল এবং এ প্রথা হয়ে উঠেছিলো কৃষক শোষণের হাতিয়ার। এ প্রথার বিরুদ্ধে ১৯২২-২৩ সালে বিদ্রোহ শুরু করেন সিলেট অঞ্চলের কৃষকেরা।
১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট সিলেটের বিয়ানীবাজারে নানকার বিদ্রোহীদের উপর গুলি চালায় ইস্ট-পাকিস্তান রেজিমেন্ট। শহীদ হোন পাঁচ কৃষক। তার পনেরো দিন আগে জমিদারদের লাঠিয়ালদের নির্যাতনে শহীদ হোন রজনী দাস। তাদের আত্মত্যাগে অবসান হয় জমিদারি প্রথা। কৃষকেরা পান ভূমির অধিকার।
সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী রাষ্ট্র ও সংগঠনগুলো মেহনতি মানুষের দিবস নামে মে দিবসকে অভিহিত করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আদর্শে মে দিবস শুধু শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন নয়, বরং এটি এক বিপ্লবী চেতনার প্রতীক, যা শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য, শ্রেণি-শোষণের অবসান এবং পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণহীন, সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের অনুপ্রেরণার দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যেমন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা ও ভিয়েতনাম মে দিবসকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করে, যেখানে লাল পতাকা, র্যালি ও বিপ্লবী স্লোগানের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের শক্তি ও অধিকার তুলে ধরা হয়। এই আদর্শে মে দিবস হলো শ্রমিক ও কৃষকের নেতৃত্বে নতুন সমাজ গড়ার সংকল্প ও রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রকাশভঙ্গি।
ট্রেড ইউনিয়ন ও বামপন্থী সংগঠনগুলো এ দিনটিকে শুধু শ্রমিকের নয়, সব ধরনের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে দিনটিতে। কেননা এটি শ্রমিক, কৃষক, নারী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সব ধরনের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। ট্রেড ইউনিয়ন ও বামপন্থী সংগঠনগুলো মনে করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, জমির অধিকার থেকে কৃষকের বঞ্চনা, নারী ও প্রান্তিক জনগণের বৈষম্য সবই একই শোষণব্যবস্থার অংশ। তাই মে দিবসে লাল পতাকা, মিছিল, স্লোগান ও সমাবেশের মাধ্যমে তারা এই শোষণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের ঐক্য ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে, এবং একটি সমতা ও ন্যায়ের সমাজ গড়ার স্বপ্নকে সামনে রাখে।
আধুনিক যুগে যদিও প্রযুক্তি ও শিল্পায়নে বিশ্বের অনেক দেশ উন্নতি করেছে, তবে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির মৌলিক অধিকার এখনও সুরক্ষিত হয়নি। শ্রমিকরা এখনও ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, এবং ছুটি, চিকিৎসা ও পেনশনসহ অন্যান্য মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তিভিত্তিক বা অনানুষ্ঠানিক শ্রমে নিয়োজিত শ্রমিকদের কোনও নিরাপত্তা নেই। বিশেষ করে গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণসহ বিভিন্ন খাতে তাদের শ্রমিক সংগঠন সৃষ্টি, কার্যক্রম পরিচালনা বা ধর্মঘটের অধিকারও খর্ব করা হয়ে থাকে নানা রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থের আড়ালে।
অন্যদিকে কৃষকরা এখনো ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত, এবং তাদের খরচ দিন দিন বাড়ছে। ভর্তুকি না থাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ঋণের বোঝা তাদের জীবনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। বহু কৃষক পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে দারিদ্র্যের চক্রে পড়ে থাকে, এবং অনেক জায়গায় কৃষি এখনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বাজার সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এ অবস্থায় বর্তমানে মে দিবস শ্রমিক ও কৃষকের মর্যাদা, আত্মপরিচয় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মে দিবসের মাধ্যমে শ্রমিক ও কৃষকরা কেবল উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে নয়, বরং সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেন।
তথ্যপ্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের শতকে দাঁড়িয়ে অনেকেরই মনে হতে পারে শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা এখনো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই আজকের মে দিবসে শুধু মিছিল-মিটিং বা ছুটি নয়, বরং নীতিনির্ধারকদের কাছে শ্রমিক ও কৃষকের অধিকার আদায়ে দাবি তোলা উচিৎ।
শ্রমিক সংগঠন, বামপন্থী দল ও মানবাধিকার কর্মীরা বৈষম্য, বৈশ্বিক শোষণ, কর্পোরেট আধিপত্য ও জলবায়ু সংকটের মতো বড় বড় সমস্যা নিয়েও যেন কথা বলে। এমনই পরিবেশ তৈরি করতে পারলেই মে দিবস পালন স্বার্থক হবে। তাই মে দিবস আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, এটি কেবল ইতিহাস নয়, বরং মানবিক মর্যাদা, আত্মপরিচয় এবং ন্যায়ের পক্ষে এক চলমান সংগ্রামের প্রতীক।