সিলেট অঞ্চলের যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয় সেগুলোর একটি বালু-পাথরমহালকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ভারতের সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় প্রতি বছর বর্ষায় স্রোতের সঙ্গে উজান থেকে প্রচুর বালু ও পাথর সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ি নদীতে জমা হয়। বিপুল পরিমাণ এই বালু কোথাও কোথাও নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে হাওরের ফসলি জমির কিছু অংশে মরুময়তা সৃষ্টি করে। যেমন, সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভপুর উপজেলার অন্তর্গত ধোপাজান-চলতি নদীর অতিরিক্ত বালুপ্রবাহ গতিপথ পরিবর্তন করে পার্শ্ববর্তী খরচার হাওরের গজারিয়া বিলে প্রবেশে বিল ভরাট হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে পলি পড়ে এখন ফসলি জমি হয়ে উঠেছে। বালু ভরাটের এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে রচিত একটি গানের কলি এরকম, ‘এই দেশটা নষ্ট করল পাহাড়িয়া গাঙ্গে/ দুঃখ দিল জিনারপুরে বান্ধে’। একইভাবে যাদুকাটা নদীর বালি অববাহিকা মাহরাম এলাকায় প্রবেশ করে ইতোমধ্যে শত শত একর ফসলি জমি ভরাট হয়ে মরুভূমির আকার নিয়েছে। এই মরুময়তা নিঃস্ব করেছে বহু কৃষক পরিবারকে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলে মরুময়তার হাত থেকে রক্ষায় মাহরাম নদীতে বাঁধ নির্মাণ করা হয় ।


প্রকৃতির আনুকূল্যে জমাট বাঁধা বালু-পাথর দরিদ্র মানুষের জন্য আশীর্বাদও বটে। প্রকৃতির উপহার হিসেবে প্রাপ্ত বালু-পাথর আহরণ করে চলে দরিদ্র মানুষের জীবন জীবিকা। শ্রমজীবী মানুষেরা সনাতন পদ্ধতিতে  বালতি, বেলচা নেটের সাহায্যে বালু-পাথর আহরণ করেন। হাওরাঞ্চলে শিল্পকারখানা না থাকায় এই বালু-পাথর হয়ে উঠে হাওরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন । বালু-পাথর আহরণের সহিত জড়িত  এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সনাতন পদ্ধতিতে বালু-পাথর আহরণের ইতিহাস দুই শত বছরেরও অধিক । বালু-পাথর পরিবহনে শ্রমিকগণ ‘বারকি’ নামের একটি বিশেষ ধরণের লম্বা আকৃতির কাঠের নৌকা ব্যবহার করেন। হাওরাঞ্চলে বালু-পাথর শ্রমিকেরা এই জন্য ‘বারকিশ্রমিক’ নামে পরিচিত। বারকিশ্রমিকদের আহরিত বালু-পাথর নদীর বালু-পাথরের পরিমাণ যতোটা কমায় প্রতি বছর প্রাকৃতিকভাবে পুনর্ভরণের নিয়মে সেটা ঠিকই পূর্ণ হয়ে যায়। হাওরাঞ্চলে বালু-পাথর আহরণের পেশার মানুষদের তেমন কোনও  লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় না। 


সুনামগঞ্জে এক সময়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী খান সাহেবের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সুনামগঞ্জ পরিচিতি’ গ্রন্থ পাঠে জানা যায় যে, ১৭৫৭ থেকে ১৯০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ‘জন বারকি’ নামের  এক ইংরেজ প্রকৌশলী ‘বারকি’ নৌকা তৈরি করেন। সুনামগঞ্জের আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী ‘বারকি’ নিয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। উজ্জ্বল মেহেদীর বইয়ে বারকি তৈরিসহ বারকিশ্রমিকদের জীবনের নানান কথা জানা যায়। উল্লেখিত তথ্য ও এলাকার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বোঝা যায় যে, সিলেট অঞ্চলের বালু-পাথরের ইতিহাস দুই শতবছরেরও অধিককাল হবে। ব্রিটিশ আমল থেকে আশির দশক পর্যন্ত সনাতন পদ্ধতিতে বালু-পাথর আহরিত হতো। আশির দশক পর্যন্ত আহরিত বালু-পাথর আহরণের  হাতিয়ার  ও পদ্ধতি পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য কোনও হুমকি ছিল না, বরং সনাতন পদ্ধতিতে বেলচা বালতি ও নেটের সাহায্যে বালু-পাথর আহরণ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রক্ষায় ছিল সহায়ক ও স্বাভাবিক। অর্থাৎ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেই চলতো বালু-পাথর আহরণের কর্মযজ্ঞ।


সুদীর্ঘ এই সময়ে এ অঞ্চলের প্রতিটি মহালকে কেন্দ্রকরে বালু-পাথর আহরণ ও পরিবহনের সহিত জড়িত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সমাবেশ এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটে। ক্রমে গড়ে উঠে মুদি দোকান, চায়ের দোকান, ছোট ছোট হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ নানান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অবস্থাটা এমন হয়ে পড়ে যে, বালু-পাথর আহরণের কাজ সচল থাকলে এলাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল থাকে, অন্যথায় স্থবির হয়ে পড়ে।


সিলেট অঞ্চলের বালু-পাথর মহালকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে  জীবনজীবিকা নির্ভরশীল কমপক্ষে এক কোটি শ্রমজীবী মানুষের। অপ্রিয় হলেও সত্য এই শ্রমজীবী মানুষের নেই কোনো সরকারি  পরিসংখ্যান ও স্বীকৃতি। কেমন তাদের জীবনযাপন, এ বিষয়ে রাষ্ট্র বরাবরই থেকেছে উদাসীন ও নির্বিকার।  বারকিশ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আরও জানা যায় যে,  বারকিশ্রমিকদের ইতিহাস হচ্ছে  অমানুষিক পরিশ্রম, শোষণ, উৎপীড়ন আর বঞ্চনার ইতিহাস। এক কথায় অনেকেটাই সামন্তবাদী নানকার বেগারের মতো তাঁদের জীবন। বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় এই বেগারির জীবন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। 


দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর পত্রিকার  ২৩ আগস্ট ২০২৪ তারিখে মতামত কলামে প্রকাশিত  ‘বারকিশ্রমিকদের জীবন যুদ্ধ’  রচনায় তাদের জীবনবাস্তবতার চিত্র পরিলক্ষিত হয়। মহালগুলোতে হাওরাঞ্চলের সামন্ত পরিবার থেকে আগত ব্যবসায়ীদের নিকট বারকিশ্রমিকরা সর্বদাই ছিল জিম্মি। ব্যবসায়ীদের মর্জির উপর নির্ভর ছিল বারকিশ্রমিকদের পারিশ্রমিক বা বালু-পাথরের মূল্য। শ্রমিকদের জিম্মি করে সীমাহীন লুণ্ঠনের বদৌলতেঅনেক ব্যবসায়ী রাতারাতি  টাকার কুমিরে পরিণত হয়। ব্যবসায়ীদের এই লাভের লোভ ক্রমেই  বেপরোয়া হতে থাকে।  বারকিশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশির দশকে ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের নেশায় বালিপাথর মহলে প্রবেশ ঘটায় ইঞ্জিনচালিত স্টিলবডি নৌকা। বারকিশ্রমিকদের উপেক্ষা করে শুরু হয় রাতদিন বালিপাথর উত্তোলন। ক্রমে পরিবেশের ভারসাম্য অধিক মাত্রায় হুমকির শিকারে পতিত হয়। বলে রাখা প্রয়োজন যে, আশির দশক পর্যন্ত সরকারি লোকজন টোকেনের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করতেন। বালিপাথর মহালে নব্বইয়ের দশকে যুক্ত হয় মুঘল আমলের ইজারাদারি প্রথা। ইজারা ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে মহালগুলোতে তৈরি হয় রাষ্ট্রের ভেতরে নতুন রাষ্ট্র। ইজারদার নামক জমিদারদের ইচ্ছা মাফিক চলে বালিপাথর মহাল। সরকারকে এক দুই কোটি টাকা ইজারামূল্য পরিশোধ করে মহাল থেকে নিংড়ে নেয় হাজার কোটি টাকা। ইজারাদার ও ব্যবসায়ীরা মহালে সরাসরি ইঞ্জিনচালিত স্টিলবডি নৌকা প্রবেশ ঘটানোর ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার আশঙ্কায় আশির দশক থেকেই বারকিশ্রমিকরা মহালে ইঞ্জিনচালিত স্টিলবডি নৌকা প্রবেশ নিষেধে সরকারের নিকট দাবি জানিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে। বারকিশ্রমিকদের স্মারকলিপি, প্রচারপত্র ও সংবাদমাধ্যমের তথ্য এর সাক্ষর বহন করছে। অর্থাৎ জেল, জুলুম, হামলা, মামলা উপেক্ষা করে বারকিশ্রমিকরা অস্তিত্বের প্রশ্নে সোচ্চার ছিল সর্বদা।


আশির দশক পর্যন্ত বারকিশ্রমিকদের কথা জনসমাজে ছিল অনালোচিত। নব্বইয়ের দশকে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রচারিত হলে জনসম্মুখে আসতে থাকে বারকিশ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যার কথা। মহালে ইঞ্জিনচালিত স্টিলবডি নৌকা প্রবেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচি হিসাবে পাথরমহালে বারকিশ্রমিকরা লাগাতার ১৬/ ১৮ দিন পর্যন্ত কর্মবিরতি দিয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিকমিছিল সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে প্রশাসন থেকে জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত স্মারকলিপি প্রদান করেছে, কিন্তু মহালে ইঞ্জিনচালিত স্টিলবডি নৌকা প্রবেশ বন্ধ হয়নি। বরং বিশ শতকে বালু-পাথর আহরণে যুক্ত হয় ড্রেজার-বোমাসহ বিভিন্ন নামের খননযন্ত্র। আরও যুক্ত হয় ঘাটে ঘাটে বিভিন্ন নামের চাঁদাবাজি। ড্রেজার-বোমার তাণ্ডবে  একের পর এক বিলীন হতে থাকে রাস্তা ঘাট, ফসলি জমি, হাটবাজার, ধর্মীয় উপাসনালয়। সমাজের আর্থসামাজিক বিন্যাস কাঠামোর ভেতরে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বদৌলতে  এসকল অপকর্ম দিন দিন আরও পুষ্টিলাভ করে।


উচ্চআদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলে লুণ্ঠনযজ্ঞ। শ্রমিকনেতাদের দাবি ও মতামত এই সত্যকে প্রতিপন্ন করছে যে, বিংশশতকে এসে বালু-পাথরমহালে মাফিয়াচক্রের আধিপত্য পুরোমাত্রায় কায়েম হয়েছে। ড্রেজার-বোমাসহ বিভিন্ন নামের খননযন্ত্রের তাণ্ডব বন্ধের আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষ, সাধারণ এলাকাবাসী, সচেতন মহলের পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদের ভূমিকা ছিল সর্বদা সোচ্চার। ব্যাপক প্রতিবাদেও মুখে সময়ে সময়ে যে-সকল অভিযান সরকারিভাবে পরিচালিত হয়েছে, সর্বস্তরের মানুষ এই সমস্ত অভিযানকে লোক দেখানো বলছেন। ধ্বংসলীলায় লিপ্ত মাফিয়াচক্রের মূল হোতারা  বরাবরই থেকে গেছে অধরা। গণমাধ্যমের সুবাদে ড্রেজার-বোমার তাণ্ডবে পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র জনসম্মুখ এলে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লুণ্ঠনযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতরা মূল হোতাদের আড়াল করে সরকারের পক্ষ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখের ২৮.০০.০০০০.০২৮.৩১.০০৪.১৮.১২ (অংশ-১)-১৯ নম্বর স্মারকে, ‘সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি, সিলিকা বালু কোয়ারী, নুড়ীপাথর, সাদা মাটি উত্তোলনসহ অন্যান্য সকল কোয়ারির ইজারা আপাতত: বন্ধ থাকবে’ মর্মে আদেশের বলে  বালিপাথর উত্তোলনবন্ধ করে দেয়া হয়। আবার ১৩ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সাবরিনা আফরিন মুস্তফা স্বাক্ষরিত (২৮.০০.০০০০.০২৮.৩১..০০৪.১৮.১২) স্মারকে পূর্বের আদেশটি বাতিল করেন।


বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রোক্ত পত্রসমূহের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, সারা দেশে গেজেটভুক্ত কোয়ারিসমূহের ইজারা কার্যক্রম সংক্রান্ত বিষয়ে এ বিভাগের ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখের ২৮.০০.০০০০.০২৮.৩১.০০৪.১৮.১২ (অংশ-১)-১৯ নম্বর স্মারকে, ‘সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি, সিলিকা বালু কোয়ারি, নূড়ীপাথর, সাদা মাটি উত্তোলনসহ অন্যান্য সকল কোয়ারির ইজারা আপাতত: বন্ধ থাকবে’ মর্মে গৃহীত সিদ্ধান্তটি, এতদ্বারা নির্দেশক্রমে বাতিল করা হলো মর্মে সরকারি পরিপত্র জারি হয়। 


অর্ন্তবর্তী সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা ১৪ জুন সিলেটের জাফলং এসে পুনরায় ঘোষণা দিলেন, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিলেটের পাথর কোয়ারী ইজারা দেব না। সরকারি এই আদেশকে বিদগ্ধজনেরা বলেন, মাথাব্যথা নিরসনে মাথা কেটে ফেলার নির্দেশনা। কেউ কেউ এই আদেশেকে ঝড়ের সময় উট পাখির মত বালির নিচে মাথা গোঁজার শামিল বলছেন। প্রশ্ন উঠেছে, সুদীর্ঘ দুইশত বছরে বালু-পাথর মহালে গড়ে উঠা অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ড উপেক্ষা করে বালু-পাথরমহাল বন্ধ ঘোষণা কতটা যুক্তিসংগত?


সরকারের পক্ষ থেকে এরকমভাবে একেক সময়  একেক সিদ্ধান্ত দেওয়া জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং নীতি নির্ধারণে সরকারের দুর্বলতারই প্রকাশ ঘটায়। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হয়না । এইরূপ অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে আখেরে লুটেরামাফিয়াচক্রেরই জয় হয়। নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে লুণ্ঠনজীবিরা তাদের কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায় ও যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমের বদৌলতে যা নিয়মিত  জনসম্মুখে আসছে। 


মনে রাখা উচিৎ, সরকারের এসকল সিদ্ধান্তের ফলে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রতি বছর বালিপাথর নেমে আসা বন্ধ হয় না। পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে বালিপাথর নেমে আসা সচল আছে এবং এটা অব্যাহত থাকবে। এই প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করা মানে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে অস্বীকার করা। বিজ্ঞানমস্ক ও প্রকৃতিপ্রেমীরা এটা করতে পারেন না। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে উপেক্ষা করে প্রকৃতির প্রতি দরদ দেখানো ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়, যেটা করছেন তথাকথিত পরিবেশবাদীরা। যাদের চিৎকারের কারণে প্রকৃত সত্য আড়াল হয়ে  খণ্ডিত ও বিকৃত তথ্য জনসমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায় । অনেকেই এইসব তথাকথিত পরিশেবাদিদের মাফিয়াচক্রের সহযোগী ও চেলা বলেন। অনেকেই  লুণ্ঠনকারী ও তথাকথিত পরিবেশবাদীদেরকে একে অন্যের সহায়ক বলে চিহ্নিত করেন। লুণ্ঠন অব্যাহত থাকলে পরিবেশ রক্ষার নামে দাতাদের নিকট থেকে বড় বড় অনুদান ও অর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়। এই জন্য  তথাকাথিত পরিবেশবাদিরা কখনও চাইবেনা লুণ্ঠন নির্মূল হোক।


এই বালু-পাথর সনাতন পদ্ধতিতে (বালতি, বেলচা ও নেটের মাধ্যমে) আহরণ করে  যুগ যুগ ধরে জীবিকা অর্জন করে আসছেন দরিদ্র অসহায় শ্রমজীবী মানুষেরা। তাঁদের জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বা উপহাস করা সমীচীন নয়। বরং চিরচেনা সনাতনী পদ্ধতিকে হটিয়ে দিয়ে যারা যন্ত্রনির্ভর তাণ্ডব চালিয়ে বারকিশ্রমিকদের মহাল থেকে উচ্ছেদ করল কিংবা উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাণ্ডবলীলায় লিপ্ত থেকে পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি সাধনে কার্পণ্য করে নি সেই মাফিয়াচক্রের মূল হোতাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি বাস্তবায়ন না করে পাথর মহাল বন্ধ ঘোষণার বদৌলতে আসলে ব্যাপক শ্রমিক জনগোষ্ঠীকে বেকারে পরিণত করে সপরিবারে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করা হলো, ফলে একদিকে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য আরও বৃদ্ধি পাওয়াসহ অপরদিকে বালিপাথর যোগানের অভাবে সরকারি বেসরকারি নির্মাণ ব্যয়ের বহর বাড়ার সুবন্দোবস্ত হয়ে গেলো।উক্ত আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই বালিপাথরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা দুইশত বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ভেঙে পড়ে এবংতথাকথিত পরিবেশবাদীদের চাপে টনক নাড়িয়ে প্রসবিত সকল সরকারি আদেশ একেবারেই অন্তঃসারশূন্য প্রতিপন্ন হয়, যখন সংবাদমাধ্যমে নিত্য প্রচারিত হতে থাকে ভয়াবহ পাথর লুটের সংবাদ। এই সংবাদগুলো এটাই প্রমাণ করে যে, পানিপ্রবাহে বাধা দিলে পানি যেভাবে বিকল্প পথ খুঁজে নেয় ঠিক তেমনি বালিপাথর মহালে গড়ে উঠা মাফিয়াচক্রের সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে কোনও প্রকার কর্তৃপক্ষীয় আদেশ কার্যকর করা সম্ভব তো নয়ই বরং প্রাণপ্রকৃতি বিনাশী প্রক্রিয়া রাজনৈতিক-প্রশাসনিক  আশ্রয়ে আরও পরিপুষ্ট হয়ে বালিপাথর মহালগুলোতে বিকল্পপথ রূপে আগ্রাসী ও সন্ত্রসী তৎপরতা অব্যাহত রাখবে। যার বাস্তব চিত্র গণমাধ্যমের কল্যাণে প্রায়ই জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়।


বিগত ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে সুনামগঞ্জ জেলা বারকিশ্রমিক সংঘ (রেজি. নং চট্র-২৩৫৫)-এর পক্ষ থেকে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে ইজারাপ্রথা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়, ‘এসকল অপকর্মের মূলে রয়েছে মুঘল আমলে প্রবর্তিত ইজারাদারি প্রথা, যার ভেতরে লুকিয়ে আছে জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা, শঠতা, ভণ্ডামি, গুণ্ডামির আদলে জনসমাজের সম্পদ আত্মসাতের জন্যে সমাজ পরিসরে আধিপত্যের বিস্তার।’ এই স্মারকলিপিতে মহালের (কোয়ারি) ইজারা পদ্ধতি বাতিল করে বালিপাথর সরকারিভাবে ‘ক্রয়বিক্রয় কেন্দ্র’ চালুর দাবিতে সাত দফা দাবিনামা পেশ করা হয়েছে। 


দাবিসমূহ হলো (১). সরকারিভাবে বালিপাথর ক্রয়বিক্রয় কেন্দ্র অবিলম্বে চালু করে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। (২). পরিবেশবিধ্বংসী বোমা মেশিন, শ্যালো মেশিন, ড্রেজার ও সেইভের সাহায্যে নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। (৩). যাদুকাটা ও ধোপাজান পাথর বালু মহালে ইঞ্জিনচালিত স্টিলবডি নৌকা সরাসরি প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। (৪). সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিকদের জিম্মি করা বন্ধ করতে হবে। (৫). পরিবেশবান্ধব উপায়ে হাতে ব্যবহারযোগ্য বেলচা, বালতি ও নেটের সাহায্যে বালু-পাথর, কয়লা আহরণ উন্মুক্ত করতে হবে। (৬). উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্যকারিসহ বোমা মেশিন, শ্যালো মেশিন, ড্রেজার, সেইভের মাধ্যমে নদী, পাহাড়, জনপদ ধ্বংসকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। (৭). সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা অবিলম্বে চালু করতে হবে।


সুনামগঞ্জসহ বৃহত্তর সিলেটে অবস্থিত বালু-পাথর মহালগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রশ্রয়ে পুষ্টি লাভ করে ব্যবসায়ী-ইজারাদার গোষ্ঠী আধিপত্য বিস্তার করে  আসছে কমপক্ষে দীর্ঘ সাড়ে চার দশক ধরে। এই দীর্ঘ সময়জুড়ে বারকিশ্রমিকরা এক অবর্ণনীয় সীমাহীন নিপীড়ন, শোষণ ও বঞ্চনার শিকারে পরিণত হওয়ার নির্মম বাস্তবতার ভেতর দিয়ে কালাতিপাত করেছেন। বারকিশ্রমিকরা তাদের এই বাস্তব জীবনের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকেই দাবিগুলো পেশ করেছেন।


প্রতি বছর প্রাকৃতিক নিয়মে উজান থেকে বালিপাথর নেমে আসে এবং আপাতত  বন্ধ হবার নয়। তাই সিলেট অঞ্চলের বালিপাথর মহালগুলো সচল রাখাই  স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মহালগুলো সচল রাখার সঙ্গে মহালসংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী মানুষ বিশেষ করে বারকিশ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি না পাওয়া বা তাঁদের স্বার্থবঞ্চনাকে সচল রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। ইতিহাস বলছে, মহালের ইজারাদার কর্তৃক নির্যাতিত ও শোষিত হয়ে আসচেন বারকিশ্রমিক ছাড়াও মহালসংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশার মানুষেরাও। তাই মহালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা বালিপাথর আহরণ/উত্তোলন পরিবহনসহ সকল অর্থনৈতিক করর্মকাণ্ড সচল রাখার পরিপ্রেক্ষিতে অপরিহার্য পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার স্বার্থে কয়েকটি সুপারিশ পেশ করছি, রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত নীতিনির্ধারক মহলের কাছে। 


(১) বালু-পাথর মহাল নিয়ে বারকিশ্রমিকদের পেশকৃত দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রথমে মুঘল আমলের ইজারা প্রথা বাতিল করে সরকারিভাবে ‘ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্র’ চালু করতে হবে। (২) সনাতন পদ্ধতিতে (বারকি, বেলচা, বালতি ও নেট সহযোগে) বালিপাথর উত্তোলন কার্যকর করতে হবে। পরিবেশবান্ধব এই দাবি শুধু শ্রমিকদের নয়, সকল সচেতন মহলের। এই পদ্ধতিতে পরিবেশের ভারসাম্য সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই রক্ষিত হয়। এই কারণে এই দাবিটি বাস্তবায়নে সরকারি নীতিমালা আমূল পরিবর্তন করতে হবে। (৩) ইজারা পদ্ধতি বাতিল করে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর  হাইড্র্রোগ্রাফিক সার্ভের মাধ্যমে কোয়ারিতে (মহালে) বালিপাথরের মওজুদ নির্ণয় সাপেক্ষে বাৎসরিক বালিপাথর উত্তোলনের পরিমাণ  নির্ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী বালিপাথর উত্তোলনে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা।সরকারের বর্তমান ইজারা নীতিমালায় বালি পাথর উত্তোলনের নির্দিষ্ট কোনও পরিমাণ না থকায় ইজারাদার ও ব্যবসায়ীরা ইচ্ছাাফিক বালি পাথর উত্তোলন করেন, পরিণামে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয় ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। (৪) সরকারি রাজস্ব যথাযথভাবে আদায়ের লক্ষ্যে সকল প্রকার বালি ও পাথরের আলাদাভাবে সরকারি মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। এই পদ্ধতি চালু হলে সকল ব্যসায়ীগণ সরকারের লাইসেন্সের আওতায় আসবেনএবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। যা বর্তমান পদ্ধতিতে সম্ভব হয়না । (৫) পাথরবালি মহালে যান্ত্রিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের পরিবেশ আইন পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করার পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে সাপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। বালিপাথর মহালে সনাতন পদ্ধতিতে বালিপাথর আহরণকারী ব্যতীত অন্যদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে হবে। (৬) বোল্ডার পাথর, ভূতু পাথর, নুড়ি পাথর,সিঙ্গেল পাথর, সিলিকা বালুসহ বিভিন্ন প্রকার  বালু ও পাথরের সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। এতে শ্রমিকগণ ন্যায্য মজুরি পাবেন এবং সরকারি রাজস্ব আদায় সহজ হবে ও বৃদ্ধি পাবে। (৭) মাফিয়াচক্রের আধিপত্য বিস্তার রোধে বালিপাথর মহালগুলোকে একধরণের সংরক্ষিত এলাকার মতো (বাফার জোন, কোর জোন, সাধারণ জোন) করে তোলতে হবে এবং সনাতন পদ্ধতিতে বালু-পাথর আহরণের (ড্রেজার-বোমাসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে বালুপাথর উত্তোলন নয়) করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (৮) বালি পাথর বোঝাই ও পরিবহণের ক্ষেত্রে জাহাজ,বাল্গহেড, স্টিলবডি নৌকা, ,ট্রাক ও  লরি ইত্যাদি মহালের সীমানার বাহিরে রাখার স্থান নির্ধারণ করতে হবে। (৯) সরকারিভাবে ক্রয় বিক্রয়কেন্দ্র চালু করে খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত ‘টিসিবি’র আদলে বালুপাথরের মূল্যনির্ধারণ পূর্বক ক্রয়ক্রিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। টিসিবির পণ্য ক্রয়বিক্রয়ে সরকার নির্ধারিত ব্যবসায়ীরা নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা নির্দিষ্ট নিয়মে সরকারি কোষাগারে সরকারের প্রাপ্য ভ্যাট, ট্যাক্স ও পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেন। বালুপাথর মহালে অনুরূপভাবে নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীরা সরকারি কোষাগারে সরকার নির্ধারিত ভ্যাট, ট্যাক্স ও রয়েলিটি পরিশোধ করবেন এবং তারা এইভাবে সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ বালু-পাথর সরকার নির্ধারিত স্থান থেকে ক্রয় এবং বিক্রয় করবেন। 


ইজারা প্রথা বাতিল করে প্রস্তাবিত এই পদ্ধতিতে সরকার রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা নিলে বর্তমান ইজারা পদ্ধতির চেয়ে শতগুণ বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিকল্প ব্যবস্থাপনা যদি সরকার অবলম্বন করতে পারেন তাহলে আরও ভালো হয়। এর ফলে বালুপাথর মহালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যাপক আর্থনীতিক কর্মকাণ্ড সচল থাকবে, লক্ষ লক্ষ বালু-পাথর শ্রমিকের জীবনজীবিকা সচল ও সহজ হবে, মাফিয়াচক্রের আধিপত্য হ্র্রাস হবে, সরকারি রাজস্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখিত দাবি আদায়ে শ্রমজীবি মানুষের পাশাপাশি শ্রেনী সচেতন সকলের সোচ্চার থাকতে হবে অন্যথায় দাবি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় ।


  • সাইফুল আলম ছদরুল সাবেক ছাত্রনেতা, হাওরে ভাসানপানি আন্দোলন ও শ্রমিক সংগঠনের সংগঠক


[সিলেট ভয়েস-এ প্রকাশিত অভিমত, মতামত, কলাম ও চিঠিপত্র একান্তই লেখকের নিজস্ব। এতে প্রকাশিত মন্তব্য, বিশ্লেষণ বা বক্তব্য সিলেট ভয়েস-এর অবস্থান, নীতিমালা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে। লেখকের উপস্থাপিত তথ্য বা বক্তব্যের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজের।]


শেয়ার করুনঃ