ড. ইফতেখার আহমদ
আন্তর্জাতিক চা দিবস: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ও চা শিল্পে AI প্রযুক্তির ব্যবহার
উজ্জ্বল মেহেদী
প্রকাশঃ ২১ এপ্রিল, ২০২৫ ৩:৫০ পূর্বাহ্ন
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সিলেট দপ্তরের দপ্তরি বলে কথা! বড্ড গাড়িবিলাসী। যে গাড়িটি চালাতেন, সেটি পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ছিল। মালিকানা বদল করা হয়েছিল। বিআরটিএর তথ্যমতে গাড়িটি কয়েক হাত বদল করে সর্বশেষ ক্রেতা শফিউল আলম। তার ডাক নাম জুয়েল। এ নামটি প্রবল প্রতাপের সঙ্গে শুনেছি আওয়ামী ক্ষমতাকালে। দপ্তরখানা এতটাই সাজানো ছিল যে, এক টুকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মতো দেখাতো। ঘটা করে উদ্বোধনও হয়েছিল। ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনে কয়েক সাংবাদিকও সেখানে নিয়ম করে যেতেন, বসতেন। তাদের মাধ্যমে যতকিঞ্চিৎ জেনেছিলামও। কিন্তু অজানা ছিল সেখানকার দাপ্তরিক আস্ফালন। রীতিমত একটি তদবিরালয় ছিল সেটি।
যাক, দপ্তরটি নয়—বলছিলাম গাড়ি দিয়ে হাটে হাঁড়ি ভাঙা নিয়ে। তো ওই গাড়িটি কেনাবেচার হাটে উঠেছিল, না উপঢৌকন হিসেবে ক্ষমতার পিছু পিছু ঘুরছিল—জানা নেই। জানার মধ্যে এলো ব্রিটেনে থাকা একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি গাড়িটিকে ‘গনিমতের মাল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই নামায়নই চাঞ্চল্য সৃষ্টির কারণ।
গনি মানে ধনী। এ জন্যই হয়তো কথার ক্যারিকাচারে ‘মালে গনি’ বলার প্রচলনও প্রবাদের মতো। গনি যে ধনী, তা কিন্তু ছোটবেলা পাঠাভ্যাস গড়ার ছড়াপাঠের মধ্য দিয়ে জানা ছিল না। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘গনি মিয়া একজন গরিব কৃষক!’ জানা হয়েছিল তখন, যখন ইসলামের ইতিহাস পাঠ সম্পন্ন হয়। ‘গনি শব্দের অর্থ ধনী, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.)-এর একটি উপাধী ছিল গনি। এই সূত্রে খলিফাকে ওসমান গনিও বলা হতো।’ ব্যস, গনি-ধনী ব্যবচ্ছেদে পাঠ্যবইয়ের সেই গনি মিয়া নিছক গরিব কৃষক হয়েই থাকলেন।
গনিমত কাকে বলে? ইসলামের দৃষ্টিতে এ প্রশ্নেরও উত্তর আছে। অমুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে রণক্ষেত্রে বিজয়ী হবার পর যুদ্ধের ময়দানে পরিত্যক্ত সম্পদ মুসলিম সম্প্রদায়ের হস্তগত হলে তাকে গনিমত বলে। যেমন, যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যসামগ্রী ও যানবাহনসহ প্রভৃতি। গনিমতের মাল বা সম্পদ বণ্টননীতিও রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের জন্য এই গনিমতের সম্পদ হালাল করে দিয়েছেন। আগের উম্মতের জন্য তা হালাল ছিল না; যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে পাওয়া সব সম্পদ এক জায়গায় জমা করলে আসমান থেকে আগুন এসে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিত। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনব্যবস্থায় যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ রাষ্ট্রের কাছে জমা দিতে হয়। কোনো সৈন্যের জন্য তা থেকে বণ্টনের আগে কোনো বস্তু রেখে দেওয়ার অনুমতি নেই। রাষ্ট্রপ্রধান সেই সম্পদ বণ্টন করবেন। তাফসিরে ইবনে কাসিরে এসেছে, যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। এর চার ভাগ যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর বাকি এক–পঞ্চমাংশ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। প্রথম ভাগ আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য। এই অংশ মুসলিমদের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যয় হবে। দ্বিতীয় ভাগ মুহাম্মদ (সা.)-এর স্বজনদের জন্য নির্ধারিত। বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব। তৃতীয় ভাগ এতিমদের জন্য সুনির্দিষ্ট। চতুর্থ ভাগ ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং পঞ্চম ভাগ মুসাফিরদের জন্য।’
গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আমাদের সাংবাদিকতা আর ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতা প্রায় একাকার। তবে আমার বড়াই বরাবর বাবুই পাখির বাসা বুনার মতো। ‘শিল্পের বড়াই’ বলতে অনুসন্ধানী চোখ আর প্রভাব-প্রতিপত্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা। এক চোখ ফেরাতেই আরেক দিকে চোখ পড়ে। এড়াতে পারি না। যেখানেই চোখ রাখি, সেখানেই একই গল্প—'লুটপাট। প্রকাশ্যেই হয়েছে বলে বলি, লুটতরাজ! তবু তো ষোলআনা পূর্ণ হয় না। অপূর্ণতায় তাই পেছন ফিরে দেখা। কর্তৃত্ববাদের জমানায় জমাট রক্তলুলুপে ‘লুটেপুটে বড়লোক’, অথবা ‘ফুলে ফেঁপে বীর’ বাক্যবানে রিপোর্ট করে মনে মনে বলি—'রাজনীতির রাজত্বে নিত্য নতুন রাজারা যদি সেই একই কাণ্ডকীর্তি করে, তাদের তরে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে অপেক্ষায় থাকব।
বলতে গেলে সেই অপেক্ষার প্রভাতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিক্রি করা গাড়িটি ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে প্রকাশ পাওয়ায় ধরা পড়ে সাংবাদিকতার ছকে। তাতে অবশ্য রাজনীতিবিদের আক্ষেপ, ‘ইগনোর করলেই পারতেন! ৫ আগস্টের আগে তো কতকিছু ইগনোর হয়েছে!’
ইগনোর আগে হয়েছে কি না, জানা নেই। যদি হয়, তাহলে স্বাধীনতার সুখ মিটে কী করে? এ জন্যই হয়তো পারিনি। পারিনি বলে ‘ইগনোর’ ঘুরে গেছে অন্যদিকে, অন্যখানে। স্থানটি হাওরাঞ্চল। ১৯ এপ্রিল সংবাদ সংস্থা বাসস-এর একটি সংবাদ শিরোনামে চোখ আটকে গেল। ‘হাওরে ইজারা থাকা উচিত নয়’। বলেছেন অন্তবর্তী সরকারের মৎস ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার। রিপোর্টটি পড়তে গিয়ে দেখি আয়োজনটি ঢাকার। আয়োজক পরিবেশবাদী সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)। বিষয় ‘সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি-২০০৯: হাওর অঞ্চলে বৈষম্য ও অব্যবস্থাপনা’।
উপদেষ্টা বলেছেন, কোনো হাওরে ইজারা থাকা উচিৎ নয়। হাওর ওই অঞ্চলের মানুষের অধিকার, আর তা রক্ষা করতে হবে। হাওরের মালিক মূলত কে? প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, আসলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে হাওরগুলো রয়েছে। যদিও অধিকাংশ হাওর এলাকা ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যারা শুধু ইজারা দিয়ে এখান থেকে রাজস্ব আহরণ করে। হাওরকে ঘিরে একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। হাওরাঞ্চলের ২৯ শতাংশ মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরার আহ্বায়ক রাশেদা কে চৌধূরীর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেন বারসিক পরিচালক পাভেল পার্থ, হাওর সংস্কৃতি অধ্যয়ন এবং গবেষণা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সজল কান্তি সরকার, মানবাধিকার কর্মী জাকিয়া শিশির, হাওর উন্নয়ন আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ-এর নির্বাহী পরিচালক ড. এম মোখলেসুর রহমান। হাওরাঞ্চলে বৈষম্য ও অব্যবস্থাপনা বিষয় উপস্থাপনা করেন অ্যাসোসিয়েটস ফর ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এআইআরডি) পরিচালক আব্দুল হাই চৌধুরী।
সেখানে হাজির হয়ে মত প্রকাশ করে এসেছেন আহাদ খান, অঞ্জনা বিশ্বাস ও বোরহান উদ্দিন নামের আরও তিনজন। তারা হাওরবাসী ভুক্তভোগী। তাদের কথাও এসেছে বাসসের সংবাদে। আরও বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এসেছে। বাসস যেহেতু সরকারি সংস্থা, তাই সরকার যেন কোনো বাছ-বিচার না করে তাদের কথা আর্কাইভে রেখে দেয়। তারা বলেছেন, হাওরের বিল ইজারা প্রায় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালী মহাজনদের হাতেই যায়, যার ফলে সাধারণ মৎস্যজীবীরা বঞ্চিত হয়। মৎস্যজীবী সমিতির নামে হাওর ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রেও নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও তাদের সমর্থকরা হাওর লিজ নিয়ে থাকে। হাওর বিল লিজ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রকৃত সাধারণ মৎস্যজীবী বা মৎস্যচাষীরা পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
মনে প্রাণে হাওরবাসীর কথা প্রথম শোনা হয়েছিল সেই ১৯৯৭ সালে। হাওরে ভাসনাপানির আন্দোলন করে ক্লান্ত গণরাজনীতিবিদ বরুণ রায়ের মুখে। তিনি বলতেন, ইজারাদারি আর জমিদারি এক কথা। ইজারা প্রথা বিলুপ্তির তাগাদায় বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ এক মুখ ক্ষোভ নিয়ে বলতেন, 'ইট মাস্ট গো'! তারপর অনেক পথ ও পন্থার সঙ্গে লড়াই। এরমধ্যে একটি
হাওরের গডফাদার 'ওয়াটার লর্ড'! এ কথাটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল বাংলাদেশের পার্লামেন্টারিয়ানখ্যাতির রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মাধ্যমে। কিন্তু কে ওয়াটার লর্ড? রাজনৈতিক প্রভাব ভেদ করে ঠিকঠাক চিহ্নিত করা কঠিন ছিল। সেই 'কঠিনেরে' ভালোবেসেছিলাম বলে থামিনি—থামেনি কলমও।
এক টাঙ্গুয়ার হাওর ঘিরে ছিল যত উত্তাপ। ওয়াটার লর্ড ব্যবচ্ছেদে নামের আদ্যাক্ষর ধরে প্রথম রিপোর্ট, অতঃপর লেগে থাকা—একের পর এক রিপোর্ট। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল, উন্মোচন সম্ভব হয়েছিল ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর। তখন নতুন সরকারের সূচনাতে চলছিল সেনা অভিযান। সারা দেশের মতো সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলেও চলে 'অপারেশন ক্লিন হার্ট'। সেই এক অভিযানে জল ও জলা যেন 'ক্লিন'! জলজল্লুশ হয়ে ধরা পড়েছিল এক ওয়াটার লর্ড। তবে উন্মোচন উন্মীলনে রূপ নিতে পারেনি। কারণ, পাঁচ বছর পর সরকারের পালাবদলে ক্ষমতাসীনদের দাপটে হাওরাঞ্চলে সবাই রাজা! সবাই ওয়াটার লর্ড! তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যে বিশেষ কোনো নামকরণ ছিল নামকাওয়াস্ত ব্যাপার।
প্রায় দুই যুগ পর সেই ওয়াটার লর্ড এলাকায় পা। জলে জিউল জনতা জনার্ধন থেকে জানা গেল ওয়াটার লর্ড প্রভাবে ঘটেছে বিরাট বিবর্তন। জলমহালে মৎসসম্পদ ছাড়িয়ে বালু-পাথর-খনিজসম্পদ আহরণে জন্ম নিয়েছে জোর-জবরদস্তির আরেক প্রভাব। সবই যেন 'গনিমতের মাল'! আছে জলমহালও। এতিম-মিসকিন-মুসাফিরদের মতো ভাগ বন্টন হয়েছে। কে, কারা এরা?
হাওর এলাকার মধ্যমণি হয়ে থাকা চারটি উপজেলা থেকে পাওয়া গেছে কাবু করার জাদুকরি একটি নাম—'কিং...'! এ কী ওয়াটার লর্ড বধ্ করে 'কিং'? রাজনীতির এই হিংটিংচটে কিংয়ে কাবু মানে কিংকর্তবিমূঢ় হয়ে থাকা! আমি তো কস্মিনকালেও কাবু হইনি, তাই কলম চলবে গনিমতের মাল বানিয়ে দেওয়া জলমহাল থেকে জলমহালে। এ জন্য খুঁজছি একজন বংশীবাদক। কারণ, অসুর দূর করতে আগে দরকার বাঁশির সুর।