আব্দুল হাই আল-হাদী

বাংলাদেশের পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে, সে ব্যাপারে কোন সুস্থ্য মানুষ দ্বিমত পোষণ করেনা। প্রাণ, পরিবেশ আর প্রকৃতির রোদন আর আর্তনাদ কান পাতলেই শোনা যায়। নদী-নালা, খাল-বিল,হাওর-বাওর, ডোবা-জলাশয়, পাহাড়-টিলা, বন-বাদাড়, পানি-বাতাস সবখানেই কেবল ধ্বংসের তান্ডবলীলা।

 

এক্ষেত্রে মূল দায় অবশ্যই সরকারের এবং প্রণিত আইন ও নীতিমালার প্রায়োগিক ব্যর্থতা। এসবকে একপাশে তুলে রেখে বলা বৃত্তের বাইরে চিন্তা করলে দেখা যায়, জনগণের সম্মিলিত মনোজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিও একটি বড় কারণ যেটি পরিবেশ সুরক্ষার কাজকে বাধাগ্রস্থ করছে। পরিবেশের প্রতি মানুষের মনোভাব ও আচরণ দেখলেই বুঝা যায় যে, তা কতো ভয়াবহ, নিষ্টুর, অমানবিক ও নেতিবাচক।

 

এমনকি এটাকে মনোজাগতিক বিকৃতি বললেও অত্যুক্তি হবেনা। মানুষের মনস্তস্ত¡ বুঝতে পারা এবং তার পরিবর্তনের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল আইনের মাধ্যমে পরিবেশের বিপর্যয় রোধ অসম্ভব। আর মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তনে রাষ্ট্রের নীতি ও কর্মসূচি একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।  


পরিবেশের প্রতি মানুষের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন-তার গভীরে যাওয়ার আগে প্রথমেই ’উন্নয়নের মায়াজাল’ সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত প্রয়োজন। ’উন্নয়ন’ নামক বড়ি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে এমনভাবে গেলানো হয়েছে যেন তা ’সর্বরোগের মহৌষধ’।

 

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যত নীতি ও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেসবের সবগুলোতে ’উন্নয়ন’কে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন তা ছাড়া মানব জনম অচল, অনঢ় ও ব্যর্থ। পাশ্চাত্য উন্নয়ন মডেল ও তত্ত¡ প্রভাবিত এসব উন্নয়নচিন্তা এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে উপলব্ধি করানো হয়েছে যে, সাধারণ মানুষরা এখনও ’সেকেলে’ ’আদিম’, ’বর্বর’ ’অসভ্য’,’পশ্চাৎপদ’। তাদেরকে আধুনিক,অগ্রসর ও সভ্য হতে হবে এবং সে সভ্যকরণের একমাত্র পথ ও পাথেয় হচ্ছে উন্নয়ন। জাতীয় ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে এমন বয়ান ক্রমাগত বলে আমপাবলিকের মগজধোলাই করা হয়েছে। সে বয়ান এখনও যে বন্ধ হয়েছে, তা বলা যাবে না।   

 

ব্রেনওয়াশের পর উন্নয়নের নমুনা খানিকটা দোরগোড়ায় হাজির করা হয়। গ্রামের রাস্তাগুলো আস্তে আস্তে কংক্রিটের পাকা সড়ক হলো। বহুতল ভবন, সেতু আর পাকাকরণের জোয়ার বইলো। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ের প্রতি জোর দেওয়া হলো। ’মগজধোলাই’ মানুষও আস্তে আস্তে নিজেদের আধুনিক ও সভ্য ভাবতে শুরু করলো । উন্নয়ন হলেই তাদের গ্রামের কাঁচা রাস্তাটি পাকা, টিনশেডের স্কুল ভবনটির দ্বিতলকরণ, খেয়ার পরিবর্তে সেতু, চুন-সুরকির সে ঐতিহাসিক মসজিদটির চাকচিক্য, বিদ্যুতের আলো, বাপ-দাদার বাড়িঘর ভেঙ্গে কংক্রিটকরণ ইত্যাদি বিচিত্র ও বহুবিধ মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।  যা কিছু অতীতের, গৌরবের, প্রয়োজনের, পরিবেশের সবকিছুই বদলাতে হবে। তাই উন্নয়ন মায়াজালে রীতিমতো প্রতিযোগীতা শুরু হলো।

 

একইসাথে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাজারে প্রবেশের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর প্রস্তুতি দেখে সরব হলো। কর্পোরেট বেপারা প্রসাধন, নির্মাণ, খাদ্য, বিলাসীপণ্য, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি জীবনের যত বিলাসী দ্রব্য আছে, সে সবের পসরা নিয়ে এগিয়ে আসলো। ’কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটি’-সিএসআর আর বিজ্ঞাপনের মোহমায়ায় ’একুশ শতকের জীবনধারায়’ ভোগের বস্তুবাদীতার দিকে মানুষও জোরওকদমে এগুতো থাকলো।  

 

এসব পরিচিতকরণ, অভ্যস্থকরণ কিংবা গলাধ:করণ পাপ বা দোষের কিছু নয়। দোষ বা পাপ যেটি করা হয়েছে, সেটি হচ্ছে উন্নয়নের একরৈখিক ধারণার সাথে পরিচিতকরণ কিংবা এমন ধারণা থেকে উদ্ভূত প্রকল্প বাস্তবায়ন। উন্নয়নের সাথে যে পরিবেশের একটি নিবিড় সম্পর্ক সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। উন্নয়ন যে একটি সামগ্রিক ব্যাপার, এর সাথে যে প্রাণ, পরিবেশ, ইতিহাস ও প্রকৃতির একটি যোগসূত্র আছে, সেটিকে উন্নয়ন চিন্তায় অন্তর্গত করা হয়নি। যদি প্রথমেই মানুষকে ’টেকসই উন্নয়ন’ সম্পর্কে কিংবা  ’অবকাঠামোগত উন্নয়ন-ই উন্নয়ন’ এমন গৎবাঁধা চিন্তার বাইরে নিয়ে এসে টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হতো , তবে মানুষের মনোজাগতিক বিকৃতি ঘটতোনা। ’সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে মানুষকে বুঝানো হতো যে, পৃথিবীর সম্পদ কোন একক প্রজন্মের ভোগের বিষয় নয়। বরং ভবিষ্যতের অনাগত প্রজন্মেরও এতে হক আছে, তবে মানুষ পরিবেশ নিয়ে অন্যভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হতো।

 

জনগণের ভোগের আগ্রাসী মনোভাব ও উদাসীনতা পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। এটিকে শুধু অজ্ঞতা বলে উপেক্ষা করা যাবে না, বরং এটি হচ্ছে পরিবেশগত পরিণতির জন্য ইচ্ছাকৃত অবহেলা।  এরকম মনোভাব প্রায়ই সামাজিক নিয়মের খিড়কিতে ঢুকে শক্তিশালী হয়, যেটি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই চর্চার চেয়ে নগদ লাভকে গুরুত্ব দেয়। এজন্য দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পরিবেশগত বিষয়ে কিছু সচেতনতা থাকলেও , এই সচেতনতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সক্রিয় আচরণে রৃপান্তরিত হয়না।

 

অপরদিকে দেখা যায়, পরিবেশ ধ্বংসের জন্য যারা সবচেয়ে বেশি দায়ী তারা সমাজের প্রভাবশালী মানুষ। দু:খজনক হলেও সত্যি যে, মুখের আড়ালে মুখোশ পরা এসব মানুষরা আবার সমাজের সবগুলো সম্মানজনক পদ অলংকৃত করেন। বহুবিধ প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষরাই তাদেরকে এসব আসনে বসিয়ে থাকে। ধর্মীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং ক্ষমতাবান মানুষেরা পরিবেশের ক্ষতিকর দিকতে উপেক্ষা করেন, অনিচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিকর চর্চাকে অনুমোদন দেন। ধ্বংসের তান্ডবনৃত্যে এগিয়ে থাকা এসব মানুষরাই আবার তাদের কৃতকর্মের দানে সৃষ্ট দুর্যোগে ত্রাণের পসরা নিয়ে সবার আগে হাজির হন। স্থায়ী নয় বরং অস্থায়ী মনভোলানো পুনর্বাসন করাই তাদের লক্ষ্য। এভাবে ধ্বংস ও অস্থায়ী পুনর্বাসনের এক দূর্বেধ্য চক্র তৈরি করে পরিবেশ ধ্বংসের প্রক্রিয়াকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে।    

 

বাংলাদেশে এখন পরিবেশ রক্ষায় নীতিমালা ও আইনের অভাব নেই। সরকার অনেক সময় পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রবর্তন করলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন মতলববাজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী অসম্ভব করে তুলে। এ গোষ্ঠীগুলো তাদের প্রভাব ব্যবহার করে বর্তমান চলমান ধ্বংসের প্রবাহ চলতে থাকতে  বাধ্য করে। তাৎক্ষণিক মুনাফাই তাদের কাছে প্রাধান্য পায়। জবাবদিহিতা ও প্রয়োগের অভাব বাংলাদের পরিবেশগত নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নকে আরও জটিল করে তুলে।

 

পরিবেশ ধ্বংসের মনস্তাত্বিক কারণগুলো বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজন। মানুষ কেন পরিবেশগত সমস্যাগুলিকে অনেক দূরবর্তী সমস্যা হিসেবে দেখে, তা উপলব্দি করা প্রয়োজন। এরকম ’মানসিক দূরত্ব’ মানুষকে ক্রমশ: নিস্ক্রিয়তার দিকে নিয়ে যায়। বাঙালির হাজার বছরের পুরনো চর্চিত পরিবেশ কেন্দ্রিক ইনসাফের ধারণাগুলো ক্রমশ: ভোতা হয়ে গেছে। পানির পথ নিয়ে আগেকার দিনে মারামারি হয়েছে, এমন ঘটনা খুব কম। মানুষ পূণ্যের আশায় পাশের বাড়ির পানির পথ সহজে ছেড়ে দিতো। কিন্তু বর্তমানে  প্রতিবেশিকে পানিতে ডুবিয়ে মারতে পারলেই সে যে জনমের তৃপ্তি পায়। প্রাণিজগতের অন্যদের প্রতি ভালোবাসা উবে গেছে। বিশাল সৃষ্টিরাজ্যের যে ঐক্যতান, সেটি ধ্বংসের মনস্তত্ত¡ খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

 

পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে মানুষ মারাত্বক স্বাস্থ্যগত ক্ষতির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্বক হুমকির সম্মুখিন। জীববৈচিত্র্যর ক্ষতি তো অপরিমেয়। সবচেয়ে বেশি মানুষ অর্থনেতিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। সবশেষে পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুর। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সারি ক্রমশ: দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর অবসান প্রয়োজন।

 

তাই নীতিনির্ধারকদের পরিবেশ রক্ষা চিন্তার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। যেকোন উন্নয়ন প্রকল্পে লোকদেখানো নয়, সত্যিকার অর্থেই পরিবেশ ভাবনাকে আগে রাখতে হবে। মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তনের প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন। মানুষকে আরও বেশি সচেতন করতে হবে। ধর্মীয় নেতা ও ধর্মাচারকে প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষকে দায় চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বের করে নিজেদের আত্বজাগরণের শক্তিতে দাঁড় করাতে করাতে হবে। মানুষের অজ্ঞতা, স্বার্থপতা, নগদ লাভের আসক্তি ইত্যাদি সমস্ত বদখাসলত থেকে বের করে আনতে পারলেই তবে সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

---আব্দুল হাই আল-হাদী, লেখক ও পরিবেশকর্মী।   

 [সিলেট ভয়েস-এ প্রকাশিত অভিমত, মতামত, কলাম ও চিঠিপত্র একান্তই লেখকের নিজস্ব। এতে প্রকাশিত মন্তব্য, বিশ্লেষণ বা বক্তব্য সিলেট ভয়েস-এর অবস্থান, নীতিমালা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে। লেখকের উপস্থাপিত তথ্য বা বক্তব্যের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজের।]


শেয়ার করুনঃ