আবদুল কুদ্দুছ চৌধুরী
ব্যাটারি রিকশা: নগর জীবনের অদৃশ্য মৃত্যুঘণ্টা
আব্দুল হাই আল-হাদী
প্রকাশঃ ১২ জুন, ২০২৫ ৩:৪৭ অপরাহ্ন
নদীর পাশে ছিল তাঁদের বাড়ি। সেদিন মহিলাটি তাঁর স্বামীর সাথে নদীর তীরে দাঁড়িয়েছিলেন। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব ছিল খুবই কম। হঠাৎ মহিলার পাশে একটি গভীর ফাটল সৃষ্টি হয়। সে ফাটলের গর্তে তিনি পড়ে যান এবং চোখের সামনে ক্রমান্বয়ে তলিয়ে যেতে থাকেন। দাঁড়িয়ে থাকা স্বামী গর্তে তলিয়ে যেতে থাকা স্ত্রীর চুলে ধরে টেনে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন কিন্তু দেখা গেল তাঁর নিজের দাঁড়ানোর জায়গাটিও দেবে যাচ্ছে। প্রাণভয়ে তিনি স্ত্রীর চুল ছেড়ে দেন এবং দৌড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেন। গভীর ফাটলে মহিলাটি চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান এবং কখনো তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল ৪.৫০ মিনিট। আবহাওয়া ছিল অন্যদিনের মতো খুবই স্বাভাবিক। লোকজন ছিল যার যার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ কেঁপে উঠল পৃথিবী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে এক প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সবকিছু। ইতিহাসের সেই বিষাদময় কালো দিন আজ।
১২৮ বছর আগে ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক প্রলয়ংকারী ভূমিকম্প সংঘটিত হয় তখনকার আসাম প্রদেশে। পৃথিবীর ইতিহাসে যেটি ’দ্য গ্রেট আসাম আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। সিলেট ও আসামের মানুষের কাছে যেটি ’বড় বইসাল’ হিসেবে পরিচিত। দিনটি ফি বছর আসে, ভূমিকম্পও হয়, হয়তো আবারও বড় প্রলয়ংকারী রূপে আসবে কিন্তু আত্মভোলা মানুষ সে কালো দিনটির কথা বেমালুম ভুলে গেছে। সেদিনের কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা ভাগাভাগি করতে চাই যাতে সেদিনের ভয়াবহতা সহজেই বুঝা যায়।
১. তিনি ছিলেন খুবই ধার্মিক। প্রতিদিনের মতো সেদিনও তিনি ’আখড়া’তে যান এবং নির্দিষ্ট স্থানে বসে পড়েন। হঠাৎ তিনি যেখানে বসে ছিলেন ঠিক ওই জায়গাটি ফাটল ধরে উন্মুক্ত হয়ে যায়। মহিলাটি চিরদিনের মতো অদৃশ্য হয়ে যান।
২. রাতের লকআপের প্রস্তুতির জন্য সকল কয়েদি তখন প্যারেড করছিল। ঠিক তখনই ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়। এ সময় প্যারেড থেকে যে দিকে পারে পলায়ন করে। এক ঘণ্টা পরে কম্পনটি আসলে, শত শত সম্ভবত মানুষ মারা যেত। তাদের এ পলায়ন ছিল খুব ’সৌভাগ্যের পলায়ন’ যেটি তাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিল।
৩. সুনামগঞ্জের বিপরীতে জুগির গাঁও নামক গ্রামটিতে একসাথে ৩৯ জন মানুষ মারা যান কারণ পুরো গ্রামটিই নদীতে ধসে গিয়েছিল। জয়নগর বাজার জনপদটির লোকেরা একই ভাগ্য বরণ করেছিল। সেখানে একসাথে ২৯ জন মানুষ মারা যান। কিন্তু হাওরের অধিকাংশ মানুষই বেঁচে গিয়েছিল কারণ তারা ওইদিন কিংবা পরের দিন ভোরে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল কিংবা নৌকাতে পরিবারসহ আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
৪. সিলেট শহরের প্রায় সকল পাথর কিংবা চুন-সুরকির ভবন ভূমির সাথে মিশে গিয়েছিল। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৫৪৫ যার মধ্যে সিলেট শহরে ৫৫, উত্তর সিলেটের গ্রামীণ এলাকায় ১৭৮, সুনামগঞ্জে ২৮৭, হবিগঞ্জে ৭, দক্ষিণ সিলেটে ৮ এবং করিমগঞ্জে ১০।
৫. ’সকলেই সন্ত্রস্ত, স্তম্ভিত ও হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছিল। মুহূর্তে মধ্যে সমস্ত শহর ধ্বংসরাশিতে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। আসামের চিফ কমিশনার সদাশয় কটন বাহাদুর এই সংবাদ প্রাপ্তে বড় লাটের নিকট এই মর্মে টেলিগ্রাম করেন যে, সমগ্র শ্রীহট্ট শহর ধুলিসাৎ হইয়া গিয়াছে।’
কোনো কল্পকাহিনি কিংবা কোনো ভাবুকের কল্পনাপ্রসূত গল্প নয় উপরের ঘটনাগুলো। এগুলো ইতিহাস এবং এগুলো ঘটেছে সিলেটে। ইতিহাসের পাতা থেকে নেওয়া ঘটনাগুলো যে কাউকে শিউরে দিতে পারে। ঘটনাটি যেহেতু শতাধিক বছরের পুরনো, তাই বাঙালির স্মৃতিতে সেদিনটি আজ বিস্মৃত, মৃত। অথচ ধারাবাহিক ভূমিকম্পে আতঙ্কিত সিলেটের মানুষদের সেদিনকার কথা অন্তত প্রতিবছর খানিকটা হলেও মনে পড়লে হয়তোবা খানিকটা সচেতনতা বাড়তে পারে।
ভূমিকম্পের সে সময় তখনও আমরা ’প্রকৃতির সাথে’ খুব একটা সংঘর্ষে যাইনি। পাহাড়-টিলা-বন-নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওর, বন্যপ্রাণী সবকিছু প্রায় অবিকৃত ছিল। নগরায়ন কিংবা ভবন নির্মাণ প্রতিযোগিতা তখনও শুরু হয়নি। নদী-খাল-জলাশয়-হাওর-বিল কোনো কিছুই তখনো ধ্বংস করিনি। জনসংখ্যাও ছিল এখনকার চেয়ে অনেক কম। সে সময়ের ঠিক বিপরীতে এখন আমাদের অবস্থান। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার এই আমরা ব্যক্তিজীবনের বিশেষ সময়ে সুন্দর গড়ন ও সুউচ্চতা কিংবা সুঠৌলতাকে প্রাধান্য দিলেও সামষ্টিক জীবনে এটা আমাদের একেবারেই অপছন্দ। আমরা কেবল সমতল ভূমি খুঁজি, গর্ত কিংবা উঁচু পাহাড়-টিলা যেন আমাদের জানের দুশমন। সেজন্য পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করি, ভূপৃষ্ঠের গর্ত অর্থাৎ নদী, খাল, জলাশয়, দিঘি আমরা দেদারসে ভরাট করে সমতল করি।
নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সুউচ্চ ভবনের পাহাড় গড়া মানুষগুলো ভূপৃষ্ঠের সামান্য কম্পনে আজ আতঙ্কিত। আতঙ্কিত হওয়ারই কথা কারণ ’অত্যাচারী চিরকালই ভীরু’। সুউচ্চ ভবনের সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে বসে কেন যেন মনে হয় যে, আমরা একেকটা জীবন্ত কবরে বসবাস করছি। প্রাণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংসের এক অশুভ প্রতিযোগিতায় যেন আমরা মত্ত হয়ে আছি। স্মার্ট, শিক্ষিত ও আধুনিক জীবনে ভূমিকম্পের আলাপ যেন দূরবর্তী সেকেলে কোনো নস্টালজিক ভাবনা!!
লালন বলেছিলেন, সময় গেলে সাধন হবে না। আমাদের সময় চলে গেছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। সিটি কর্পোরেশন কিংবা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন রক্ষার জন্য কাজ করছেন বলে গণমাধ্যমে মাঝে খবর বের হয়। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, ইস্রাফিলের বাঁশি বেজে উঠেছে, এখন আর কোনো তওবা কিংবা নেক কাজ কবুল হবে না। প্রকৃতি তাঁর স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিশোধ নেবে। প্রকৃতি ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। জুলুম আর নিপীড়নের হিসেব পাইপাই করে মানুষকে দিতে হতে পারে।
তারপরও আশাবাদী মানুষ হিসেবে প্রত্যাশা করি, আরেকটি ১২ জুন যেন আমাদের জীবনে ও জনপদে না আসে। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির মতে, ’চালনির উপরে পরিচালিত তণ্ডুলের যেরূপ অবস্থা ঘটে, শ্রীহট্টবাসী সকলের অবস্থা তৎকালে অনেকটা সেইরূপ দাঁড়াইয়াছিল’।
(বড় বইসালের মাত্র ৮ বছরের মাথায় ১৯০৫ সালে বিসি এলেন সিএস সম্পাদিত ’আসাম ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারস’ এবং অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি লিখিত ১৯১০ সালের ’শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত-পূর্বাংশ’ গ্রন্থদ্বয়কে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে)