আলমগীর হোসেন

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। একজন প্রার্থীর আবেদন থেকে শুরু করে যোগদান পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ এখন সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক। এমনকি যোগদানের পর এমপিওভুক্তির আবেদন প্রক্রিয়াটিও অনলাইনে সম্পন্ন হয়। ফলে পুরো প্রক্রিয়া হয়েছে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ঝামেলামুক্ত।

এই পদ্ধতিতে ঘুষ, তদবির কিংবা অন্য কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই। স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সারা দেশে ইতোমধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার চাকরিপ্রার্থী নিযুক্ত হয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক অর্জন। চাকরি নামক সোনার হরিণের খোঁজে যেখানে লাখ লাখ বেকার যুবক হতাশায় নিমজ্জিত, সেখানে এমন একটি স্বচ্ছ ও আধুনিক পদ্ধতি তাদের মনে আশার আলো জাগিয়েছে।

তবে, শুধু শিক্ষকের নিয়োগ যথেষ্ট নয়—একটি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে এনটিআরসিএকে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। সময় এসেছে, অধ্যক্ষ ও উপ-অধ্যক্ষ নিয়োগও এনটিআরসিএর আওতায় আনার।

২০১৫ সালে এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের বিপরীতে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক নির্বাচন করে সুপারিশ করার লক্ষ্যে। এর ভিশন ছিল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাভিত্তিক শিক্ষক বাছাই নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে।

কিন্তু ২০১৫ সালের পূর্বে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হতো গভর্নিং বডির মাধ্যমে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা অধিদপ্তরের বিধিমালা অনুসরণ করে মহাপরিচালকের প্রতিনিধি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি (স্নাতক পর্যায়ের জন্য), এবং গভর্নিং বডির সদস্যদের নিয়ে গঠিত হতো নিয়োগ কমিটি। এরপর বিজ্ঞাপন প্রকাশ, আবেদন বাছাই, নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা, নিয়োগপত্র প্রদান, যোগদান এবং এমপিওভুক্তির আবেদন। প্রতিটি শূন্য পদে নিয়োগদানের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হতো। এই পদ্ধতি ছিল দীর্ঘ ও জটিল। এই ব্যবস্থায় স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ছিল প্রায়ই।


যদিও বর্তমানে শিক্ষক নিয়োগে এসব অনিয়ম অনেকটাই বন্ধ হয়েছে, কিন্তু অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগে এখনও পুরনো দুর্নীতিপূর্ণ প্রক্রিয়াই চলমান। এ নিয়োগে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী-এমপি, এমনকি স্থানীয় নেতাদের সুপারিশ নিতে হয়। বিভিন্ন স্তরের মানুষকে ম্যানেজ করা, যে কলেজে নিয়োগ পেতে চান ওই কলেজের পরিচিত কিছু শিক্ষককে খুশি করাসহ অনেক কিছুই করতে হয়। 


একজন অধ্যক্ষ যখন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে নানা প্রতিজ্ঞা করে একটা কলেজে যোগদান করেন, তখন তাকে অনেকজনকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হয়, অনেককে খুশি করতে হয়। আবার ওই কলেজের কিছু তোষামোদকারী শ্রেণীর শিক্ষককে বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। কারণ তিনি অনেকের কাছেই দায়বদ্ধ। অপরদিকে ওই শিক্ষকগণও অধ্যক্ষকে বিভিন্ন সুবিধা দেবেন।

আরেকটা বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ, একজন অধ্যক্ষ যখন লবিং করে যোগদান করেছেন, তিনি নিশ্চয়ই ওই পদের যোগ্য নন। সুতরাং অনেক বিষয়েই তার অজ্ঞতা প্রকাশ পায়। অন্যদিকে তিনি হয়তো কাউকে না কাউকে উপাধ্যক্ষ বানানোর প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন! 

ফলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর যোগ্য কাউকে এসকল প্রশাসনিক পদে পায় না। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবই এভাবেই চলছে, আর আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবার প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তার অনুসারীদের একটি গ্রুপ তৈরি করে রাখেন, যাতে তার ক্রান্তিকালে তারা তাকে রক্ষা করতে পারে। এসবই হয় বা হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে। 

এনটিআরসিএ যদি প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা সহকারী প্রধানদের নিয়োগের দায়িত্ব নেয়, তাহলে এসব জটিলতার সমাধান হবে। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হলে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে লেজুড়বৃত্তি করতে হবে না। সেখানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে চাকরির অভিজ্ঞতা, এমফিল কিংবা পিএইচডি হিসেবে আলাদা স্কোর, একাডেমিক রেজাল্টের জন্যে আলাদা স্কোর, যে প্রতিষ্ঠানে তিনি আছেন সেখানকার প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রত্যয়ন—ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

এনটিআরসিএ শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এনেছে, তা প্রশংসনীয়। এখন প্রয়োজন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়োগেও একই রকম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। 

সময় এসেছে—এনটিআরসিএ যেন আর বিলম্ব না করে অধ্যক্ষ ও উপ-অধ্যক্ষ নিয়োগের দায়িত্বও গ্রহণ করে। তবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্যকর প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গঠনমূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।


  • আলমগীর হোসেন: প্রভাষক, মইনউদ্দিন আদর্শ মহিলা কলেজ, সিলেট


[সিলেট ভয়েস-এ প্রকাশিত অভিমত, মতামত, কলাম ও চিঠিপত্র একান্তই লেখকের নিজস্ব। এতে প্রকাশিত মন্তব্য, বিশ্লেষণ বা বক্তব্য সিলেট ভয়েস-এর অবস্থান, নীতিমালা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত নাও করতে পারে। লেখকের উপস্থাপিত তথ্য বা বক্তব্যের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজের।]


শেয়ার করুনঃ