ছবিঃ কৃতজ্ঞতা মো. মুসলেহ উদ্দীন মুনাইম

সিলেট তথা দেশের ইতিহাসে মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ একটি ঐতিহ্যের নাম। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সিলেট অঞ্চলসহ গোটা দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ। 


শুধু বাংলাদেশ নয়, তৎকালীন ভারতবর্ষের শিক্ষা প্রসারেও এমসি কলেজের ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৯২৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় গৌরবময় ফলাফলের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে এমসি কলেজ।


আজ ২৭ জুন। গৌরবের ১৩৩ বছর পূর্ণ করে ১৩৪ বছরে পদার্পণ করেছে প্রাচীনতম এই প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ এই যাত্রায় প্রাপ্তির খাতায় অনেক কিছু অর্জন করেছে বিদ্যাপীঠটি। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। 


প্রায় ১১ যুগ আগে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় তাঁর মাতামহ জমিদার মুরারিচাঁদ রায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘এমসি কলেজ’। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই কলেজটি সিলেট শহরের টিলাগড় এলাকার থ্যাকারে টিলায় অবস্থিত।


দেড়শত একর আয়তনের এই শতবর্ষী এমসি কলেজ শুরুতে ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পরিচালিত হলেও বর্তমানে ১১ হাজার ৮৮৬ জন শিক্ষার্থী এই কলেজে লেখাপড়া করছেন। 


কলেজ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে (একাদশ-দ্বাদশ) শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬০০ জন। স্নাতক পাস কোর্সে (বি.এ) ৩ হাজার ৭৪০ জন, স্নাতক সম্মান শ্রেণিতে (অনার্স) ৪ হাজার ৫০৬ জন এবং মাস্টার্স পর্যায়ে (প্রিলিমিনারি ও শেষপর্ব) প্রায় ৩ হাজার ৪০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। 


তাছাড়া বর্তমানে এমসি কলেজে ১০৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। একইসঙ্গে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১৫১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিরলসভাবে কলেজের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছেন। 


আসাম প্যাটার্নে তৈরী শতাধিক বছরের পুরোনো ভবনসহ ঐতিহ্যবাহী এই কলেজে রয়েছে নতুন-পুরাতন একাধিক ভবন, লাল-সাদা পদ্মময় বিস্তীর্ণ পুকুর, পুরোনো আদলে নির্মিত শহীদ মিনার, মসজিদ ও ৩০ হাজার বই সংবলিত একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, যা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। 


১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ঐতিহ্যবাহী এই কলেজটির গোড়াপত্তন হয় ১৮৮৬ সালে ‘মুরারিচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয়’ হিসেবে। তখন সিলেট শহরের গোবিন্দচরণ পার্ক (বর্তমান হাসান মার্কেট) এলাকায় বাঁশ ও নল খাগড়া দিয়ে নির্মিত ঘরে এর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো। 


‘মুরারিচাঁদ উচ্চ বিদ্যালয়’কে অচিরেই কলেজ পর্যায়ে উন্নীতকরণের সিদ্ধান্ত নেন রাজা গিরিশ চন্দ রায়। এর ধারাবাহিকতায় ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা চালুর মাধ্যমে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজ হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে এমসি কলেজ। 


কিন্তু ১৯০৮ সালে রাজা গিরিশ চন্দ্র রায় মৃত্যুবরণ করলে অনেকটা থমকে দাঁড়ায় পরিবেশ। পরে ১৯১২ সালে আসামের চিফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্ল'র সময়ে কলেজটি সরকারি কলেজ হিসেবে অধিভুক্ত হয়। 


১৯২১ সালে তৎকালীন আসামের শিক্ষামন্ত্রী ও ‘এমসি কলজের ত্রানকর্তা’ খ্যাত খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদের (কাপ্তান মিয়া) নেতৃত্বে ক্যাম্পাসটি স্থানান্তরিত করে টিলাগড়ের থ্যাকারে টিলায় আনা হয়। ১৯২৫ সালে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে নতুন ক্যাম্পাসের উদ্বোধন হয়।  


তবে এ কলেজের শতাব্দী প্রাচীন আসাম প্যাটার্নের ভবনগুলো এখন অনেকটাই অস্তিত্ব সংকটে। একদিকে যেমন নেই সংরক্ষণের উদ্যোগ, অন্যদিকে এ ভবনগুলো অপসারণ করে নতুন ভবন নির্মাণে আগ্রহের কারণে হুমকির সম্মুখীন এই প্রাচীন বিদ্যাপীঠের অনন্য ঐতিহ্য।


ঐতিহ্যবাহী এসকল ভবন সংরক্ষণের মাধ্যমে শতাব্দী প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠের গৌরবকে সমুন্নত রাখতে দাবি জানিয়ে প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিয়ে জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করছে পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট।


১৯১২ সালে কলেজটি সরকারিকরণ হলেও কার্যক্রম ততটা অগ্রগতি হয়নি। পরে শিক্ষামন্ত্রী কাপ্তান মিয়ার নির্দেশে সিলেটের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে ১৯২১ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয় এমসি কলেজ। 


পর্যায়ক্রমে ১৯১৬ সালে ডিগ্রি কোর্স চালু ১৯২৭ সালে উপমহাদেশে গৌরবময় ফলাফল, স্নাতক সম্মান কোর্স চালুকরণের মাধ্যমে কলেজটি দিনদিন শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করে।


ইট-পাথরের ব্যস্ত শহরে এমসি কলেজ যেন শান্তির এক স্নিগ্ধ পরশ। স্থাপত্যশৈলী, টিলাবেষ্টিত ক্যাম্পাস, লাল-সাদা পদ্মফুলে ভরা পুকুর, পাখির কলতান, সবুজে ঘেরা মনোরম পরিবেশ নিসন্দেহে কলেজটির সৌন্দর্যকে স্ফুটিত করে। ফলে লেখাপড়ার দিক থেকে শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রথম সারিতে থাকে ঐতিহ্যবাহী মুরারিচাঁদ কলেজ।

Single News Bottom

শেয়ার করুনঃ

তথ্যপ্রযুক্তি-শিক্ষা থেকে আরো পড়ুন

এমসি কলেজ, সিলেট, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী