মিনিস্টার বাড়ি ভাঙার কাজ বন্ধ করেছে জেলা প্রশাসন
ইতিহাস-ঐতিহ্য
প্রকাশঃ ২৩ মে, ২০২৫ ৪:৩৪ অপরাহ্ন
৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেটের নামের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছেন হযরত শাহ্ জালাল (রহ.) এর নাম। আর ইয়েমেনী এ সুফি সাধকের সিলেট আগমনের সাথে জড়িয়ে আছে গৌড়ের রাজা গোবিন্দের পরাজয় ও ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রীহট্ট বিজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী।
ইতিহাস আমাদের অতীতের দিকে ধাবিত করে কিন্তু সে ইতিহাস প্রায়শই বিজয়ীদের গৌরবগাঁথা। আর এ কারণেই বিজয়ী হযরত শাহ্ জালাল (রহ) এর জীবন ও কর্ম নিয়ে যতটা চর্চা হয়েছে, এই হিন্দু নৃপতি গোবিন্দ সম্পর্কে তথ্যাবলী ততটাই অজানা রয়ে গেছে।
জনশ্রুতি বলে হযরত শাহ্ জালাল, তার সঙ্গীয় আউলিয়া ও দিল্লী সালতানাতের অধীন লখনৌতির নবাব শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহর সৈন্যদলের হাতে পরাজিত হওয়ার পর রাজা গোবিন্দ প্রথমে পেঁচাগড় দুর্গে আশ্রয় নেন পরে একটি গুহা দিয়ে পালিয়ে যান।
বিভিন্ন উপাখ্যানের আলোকে রাজা গোবিন্দের বংশধরদের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়, বিশেষ করে সিলেট সদর, জৈন্তাপুর এবং গোয়াইনঘাট উপজেলার পাত্র সম্প্রদার রাজা গোবিন্দের বংশধর বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে রয়েছে নানা মত।
হযরত শাহ্ জালাল (রহ) এর সিলেট বিজয়ের ৭০৬ বছর পর আমরা আলোকপাত করতে চাই গৌড়ের পরাজিত রাজা গোবিন্দের জীবনের নানা অজানা দিক সম্পর্কে।
প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি তার শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তের উত্তরাংশের দ্বিতীয় ভাগের দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতেই আলোচনা করে রাজা গোবিন্দের শাসনকাল এবং হযরত শাহ্ জালাল (রহ) এর সিলেট বিজয় ও শ্রীহট্টে মুসলমান শাসনের প্রারম্ভিক দিনগুলো নিয়ে।
গোবিন্দের জন্ম ও বংশগতির গল্প: ইতিহাস না জনশ্রুতি?
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তে অচ্যুতচরণ চৌধুরী লিখেছেন তৎকালীন শ্রীহট্ট তিনটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল– গৌড়, লাউড় এবং জয়ন্তীয়া। বর্তমানের সিলেট শহর এবং পূর্ব ও দক্ষিণে অনেকদূর বিস্তৃত এই রাজ্যের রাজা নিজেকে তিন রাজ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করতেন।
ভবানীপ্রসাদ দত্তের লিপিতে উল্লেখিত ‘সমুদ্র তনয় গৌড় গোবিন্দ নামেতে, শ্রীহট্ট দেশের রাজা ছিলেন পর্বতে’ এর উদ্ধৃত করে অচ্যুতচরণ চৌধুরী লিখেছেন যে পূর্বকালে ত্রিপুরা রাজবংশীয় কোন রাজার শত শত মহিষী বা পত্নী ছিলেন যাদের মধ্যে কোন একজনের সঙ্গে সমুদ্রদেবতা বরুণ মনুষ্যরূপে মিলিত হলে সেই মহিষী গর্ভধারণ করেন।
এ ঘটনা জানাজানি হলে রানীকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করা হয় এবং বরুণদেবের সন্তানরূপে জন্ম হয় গোবিন্দের। বরুণদেব তখন আবির্ভূত হয়ে বলেন যে তার ইচ্ছায় সমুদ্রের জল সরে গিয়ে যতদুর চরা পড়বে, ততদূর রাজ্যের অধিকারী হবেন গোবিন্দ।
অচ্যুতচরণ লিখেছেন যে প্রাচীন সিলেট একসময় সমুদ্রের (হ্রদের) কুক্ষিগত ছিল এবং সমুদ্র সরে গিয়ে গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়, অথবা গোবিন্দ ত্রিপুরার কোন নির্বাসিতা মহিষীর সন্তান বা সিলেট অঞ্চলের কোন হাওরপাড়ে জন্ম নেয়া গোবিন্দ ভাগ্যক্রমে গৌড়ের অধিপতি হয়েছিলেন।
তবে এ ইতিহাসবেত্তা গোবিন্দকে খাসিয়া (তৎকালীন সময়ে পাহাড়ের সকল অধিবাসীদের খাসিয়া মনে করা হতো) জাতীয় কোন রাজকুমার হিসেবে মানতে নারাজ কারণ গোবিন্দ ছিলেন হিন্দু নৃপতি এবং তার নামানুসারে আসামে গড়ের গোবিন্দী ব্রাক্ষণ বলে একটি ক্ষুদ্র ব্রাক্ষণবংশ রয়েছে।
“জানিহ শ্রীহট্ট নামে আছে পূর্ব্ব দেশ।
ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব্ব স্থান আছে সবিশেষ।।
গৌড় গোবিন্দ নাম তাহার নৃপতি।
শব্দভেদী বাণ যাঁর আছি অধীতি।।”
দত্তবংশাবলী উদ্ধৃত করে অচ্যুতচরণ লিখেছেন যে গোবিন্দ ছিলেন বীরপুরুষ, তিনি দূর হতে শব্দ শুনতে পেরে আড়াল থেকে লক্ষ্যভেদ করতে পারতেন। আর এ কারণে তৎকালীন মুসলমানরা গোবিন্দকে জাদুবিদ্যায় পারদর্শী হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে গোবিন্দের ৫টি গড় বা দূর্গের সন্ধান পাওয়া যায়। কালের পরিক্রমায় সেসব প্রায় ধ্বংস হয়েছে, কিছু অবশিষ্ট অংশ অযত্নে অবহেলায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসবেত্তা অচ্যুতচরণ চৌধুরী ও বর্তমানের প্রত্নতত্ত্ব গবেষক আব্দুল হাই আল-হাদীর লেখনীর তথ্যমতে রাজা গোবিন্দের গড়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা হলো।
রাজা গোবিন্দের গড় বা দুর্গের মধ্যে অন্যতম ছিল গড়-দুয়ার। বর্তমান সিলেট নগরীর আম্বরখানা এলাকায় বিমানবন্দর সড়কের পশ্চিম পাশেই গড়-দুয়ারের অবস্থান ছিল। রাজা গৌড় গোবিন্দের দুর্গপ্রাসাদ ছিল এটি। এখানেই রাজা বসবাস করতেন। নামটি ছাড়া প্রাচীন আর কোনো নিদর্শন এখানে নেই।
দত্তপাড়া (বর্তমান ঘুর্ণি আবাসিক এলাকা) এর পার্শ্ববর্তী উঁচু টিলায় গত শতাব্দীর শুরুর দিকে গড়ের ধ্বংসাবশেষের ইটের নিদর্শন ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন অচ্যুতচরণ। পরবর্তীতে ষাটের দশকে এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য পাঁচটি তিনতলা কোয়ার্টার ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ টিলার উপরে ৩৬০ আউলিয়ার এক আউলিয়ার মাজারও রয়েছে।
সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র চৌহাট্টা এলাকায় এটির অবস্থান। হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার থেকে খানেক দূরেই অবস্থিত এই টিলা আজও সিলেটবাসীর কাছে গৌড় গোবিন্দের টিলা নামে পরিচিত। এই টিলার উপর নির্মিত সুউচ্চ দূর্গে রাজা গোবিন্দের প্রধান সেনাপতি মনারায় বসবাস করতেন।
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের পর এই টিলার উপরে জজের জন্য বাংলো নির্মাণ করা হয়। তারপর থেকে এই টিলা জজের টিলা নামেও পরিচিত লাভ করে। বর্তমানে টিলার উপর জেলা জজের বাসভবন এবং টিলার একপাশের ঢালু অংশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীর বাংলো রয়েছে, রয়েছে সওজের কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার।
অচ্যুতচরণ লিখেছেন যে জজের বাংলো নির্মাণ করার সময় ৫-৬ ফুট মাটির নিচে দুটি খলপাত্র পাওয়া যায়। যার মধ্যে একটি ছিল ইগনাস রক বা আগ্নেয়গিরির অগ্নিউদগীরণের পর লাভা ঠান্ডা হয়ে রূপান্তরিত পাথর নির্মিত ১৩ ফুট দীর্ঘ, ১ ফুট প্রশস্ত এবং ৫ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট। অপরটি ছিল মাত্র ১ ফুট দীর্ঘ সেন্ডস্টোন নির্মিত। দুই ধরণের পাথরই গৌড়ের এই কেন্দ্রে থাকার কোন সম্ভাবনা ছিল না। অচ্যুতচরণের ধারণা এগুলো ভিনদেশীয় কোন সন্ন্যাসী নিয়ে এসেছিলেন কারণ ইতিহাস অনুযায়ী রাজা গোবিন্দ প্রচুর ভিনদেশীয় সন্ন্যাসদের আশ্রয় দিয়েছিলেন।
রাজা গোবিন্দের প্রধান দুর্গগুলোর অন্যতম ছিল পেঁচাগড়। সিলেট অঞ্চলের প্রসিদ্ধ ও বেশ বড় আকৃতির পেঁচাবাশ দিয়ে ঘেরা অত্যন্ত সুরক্ষিত এ দুর্গটি সিলেট থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দুরে কালাগুল চা বাগানের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিল।
এখানে এখনো কিছু রহস্যময় সুড়ঙ্গ পথের চিহ্ন এখনো রয়েছে যা স্থানীয়রা হারুংহুরুং নামে ডাকেন। অপরিচিত কারো জন্যে সেই দুর্গে যাওয়া বেশ কষ্টকর। একসময়ের জনদুর্গম এই জঙ্গলে পরবর্তিতে চা বাগান সৃষ্টি হলেও এখনো পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা ও উচু নিচু বাঁকে পথ হারানোটা অস্বাভাবিক না। তবে স্থানীয় গাইডদের সহায়তায় আজও অনেক পর্যটক দেখতে যান হারংহুর।
সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজের পেছনের টিলাটি-ই রাজা গোবিন্দের অন্যতম দুর্গ। সুউচ্চ টিলার উপর দুর্গটির অবস্থানের কারণেই এটিকে ‘টিলাগড়’ নামকরণ করা হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এখানে এখনো একটি ফটক ও ভবনের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
গোবিন্দের টিলাগড়ের নামেই বৃহত্তর ওই এলাকাকে টিলাগড় নামকরণ করা হয়েছে। তবে এটি রাজা গোবিন্দের দুর্গ হলেও বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তা জানেনা। অনেকের কাছে এটি একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বলে পরিচিত। প্রতিদিন এমসি কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ওই স্থানটি ঘুরে দেখেন। সংরক্ষণের অভাবে শহরের প্রাণ কেন্দ্রে থাকা গৌড়ের রাজা গোবিন্দের দুর্গটি অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।
খাদিমনগর চা বাগানের কিছুটা দুরেই হাওয়া-পাঙ্খা দুর্গের অবস্থান। রাজা গৌড় গোবিন্দের বিনোদন নিবাস বা বিলাসভবন ছিল এটি। এই ভবনের একটি ধ্বংসাবশেষ ও একটি কুপ এখনো রয়েছে। এই কুপটি রাজার বংশধর অর্থ্যাৎ লালেংদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান। দুর্গম এলাকা হওয়ায় খুব সহজে যাতায়াত করা যায় না। তাছাড়া রাজা গোবিন্দের বিলাস ভবনের ধ্বংসাবশেষটি অনেকের কাছে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ বলে পরিচিত। তাই হাতের কাছে থাকা প্রাচীন গৌড়ের রাজার এই হাওয়া-পাঙখা আজও অজানা।
এছাড়াও প্রাচীন গৌড়ের আরো বেশ কয়েকটি জায়গায় গোবিন্দর গড় ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যার মধ্যে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার গড়গাঁও অন্যতম।
রাজা গোবিন্দ গড় নির্মাণ ছাড়াও পাহাড়বেষ্ঠিত এই অঞ্চলের সুপেয় পানির সমস্যা নিরসনে খনন করেছিলেন একাধিক দিঘী। এসবের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘রাজার মার দিঘী’ যার অবস্থান সিলেট নগরীর বর্তমান আম্বরখানা-বড়বাজার এলাকায় ছিল। প্রায় ২০ একর জায়গা জুড়ে খনন করা এই বিশাল দিঘী ভরাট হয়েছে শতাব্দীরও বেশি সময় আগে। বর্তমানে সেখানে গড়ে উঠেছে অজস্র সুউচ্চ দালান ও বসতবাড়ি।
নগরীর শাহজালাল উপশহর এলাকায় রয়েছে হিন্দুয়ানী দিঘী এবং এর পাড়ের নাম আজও হিন্দুয়ানীরপাড় নামে পরিচিত। কথিত রয়েছে রাজা গোবিন্দ প্রতিদিন পায়ে হেঁটে এসে এখানে পূজাঅর্চনা করতেন। বর্তমানে ওই দিঘীটিরও অস্তিত সংকটে রয়েছে।
এছাড়াও বিশ্বনাথের গড়গাঁওয়ে রয়েছে রাজা গৌড় গোবিন্দের দিঘী যা ৭শতকেরও বেশি সময় ধরে এলাকাবাসীর পানির চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে।
গৌড়ের রাজা গোবিন্দকে ঘিরে যত ইতিহাস, জনশ্রুতি ও ধ্বংসপ্রায় নিদর্শন রয়েছে, তা সংরক্ষণের দাবি রাখে। হয়তো একদিন, নতুন গবেষণায় আরও পরিষ্কার হবে গৌড়ের এই শেষ নৃপতির গল্প—যে ইতিহাস শুধু পরাজয়ের নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া এক সময়ের দলিল।
গৌড় রাজা গোবিন্দ, সিলেট ইতিহাস, শাহ জালাল রহ., ১৩০৩ শ্রীহট্ট বিজয়, পেঁচাগড় দুর্গ, টিলাগড় সিলেট