প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অর্থে গড়া ‘সমৃদ্ধ অঞ্চল’ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সমাদৃত হওয়ার পর নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে সিলেটকে। বাংলাদেশের আটটি বিভাগের মধ্যে এখন সবচেয়ে দরিদ্র সিলেট।


পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বৃহস্পতিবার দেশের প্রথম জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) প্রকাশ করে। সেখানে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগের এমপিআই স্কোর ০.১৭৭, যা দেশের অন্যান্য সব বিভাগকে ছাড়িয়ে গেছে।


এই সূচক অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের ৩৭.৭০ শতাংশ, অর্থাৎ ৪০.২৯ লাখ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। এতে দারিদ্র্যের দিক থেকে ঐতিহ্যগতভাবে পিছিয়ে থাকা বরিশাল ও ময়মনসিংহকেও পেছনে ফেলেছে সিলেট।


এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হলো—যারা সিলেটে দরিদ্র, তারা দেশের অন্য এলাকার দরিদ্রদের তুলনায় আরও বেশি মাত্রায় বঞ্চনার শিকার। কারণ এখানকার দারিদ্র্যের তীব্রতা ৪৬.৮৬ শতাংশ, যা জাতীয়ভাবে সর্বোচ্চ।


এছাড়া, সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলা এমপিআই স্কোর ০.২২৫ নিয়ে দেশের তৃতীয় দরিদ্রতম জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সুনামগঞ্জের বাস্তবতার ফলে পুরো বিভাগের সামগ্রিক চিত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।


এই সূচকটি ২০১৯ সালের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (MICS)-এর তথ্যের ভিত্তিতে ইউনিসেফ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড পভার্টি এন্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ এর সহায়তায় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় তৈরি করেছে পরিকল্পনা কমিশন। 


সূচকে দেখা গেছে, জাতীয়ভাবে ২৪.০৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার, যেখানে দরিদ্রদের মধ্যে গড় বঞ্চনার হার ৪৪.১৭ শতাংশ। 


সিলেট বিভাগ এককভাবে দেশের ১১.৬৬ শতাংশ দারিদ্র্যের বোঝা বহন করছে, যদিও দেশের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশেরও কম সিলেটে বাস করে।


পিছিয়ে পড়ল সিলেট, এগিয়ে গেল অন্যরা


২০১২ সালের হার্মোনাইজড (সামঞ্জস্যকৃত) তথ্য অনুযায়ী, সিলেট ছিল দেশের তৃতীয় দরিদ্রতম বিভাগ। তখন সিলেটের এমপিআই স্কোর ছিল ০.২৩৭, এবং ৫০.৩ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে ছিল। তখন বরিশাল ও ময়মনসিংহ ছিল আরও পিছিয়ে।


২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সব বিভাগই দারিদ্র্য কমাতে অগ্রগতি দেখিয়েছে এবং সিলেটের স্কোরও ০.০৬০ কমে ০.২৩৭ থেকে ০.১৭৭-এ নেমে এসেছে।


কিন্তু একই সময়ে খুলনা ও ঢাকা অনেক বেশি উন্নতি করেছে, এমনকি বরিশাল ও ময়মনসিংহও দারিদ্র্য হ্রাসে সিলেটের চেয়ে ভালো করেছে। ফলে সিলেট দরিদ্র বিভাগ হিসেবে সবার উপরে উঠে এসেছে।


বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. একে এনামুল হক বলেন, “এটি দেশের প্রথম বহুমাত্রিক দারিদ্রতা সূচক (এমপিআই), তাই তথ্যের কিছু অসামঞ্জস্যতা থাকতে পারে। সাধারণত আমরা আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্য পরিমাপ করি, কিন্তু এই সূচকটি সুবিধা পাওয়ার ভিত্তিতে তৈরি।”


তিনি আরও বলেন, “সিলেটের বিস্তৃত হাওর ও চা-বাগান অধ্যুষিত এলাকায় শিক্ষার ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত, যেটা সূচককে প্রভাবিত করেছে। তারপরও এটি একটি শিক্ষণীয় দিক—উন্নতির সুযোগ রয়েছে।”


সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার বলেন, ‘সিলেটে ঐতিহাসিকভাবে বহিরাঞ্চল থেকে অনেক মানুষ এসে বসবাস করেন এবং তাদের জীবন-জীবিকা ঐতিহ্যগতভাবে এখানকার স্থানীয়দের থেকে ভিন্ন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে শুধুমাত্র সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয় বিবেচনায় নেয়ার মাধ্যমে এই সূচকে একটি ভুল বার্তা প্রকাশ হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছি। বিষয়টি নিয়ে আরো বিষদ পরিসরে গবেষণাধর্মী কাজের এবং নতুন সূচকে অন্যান্য অর্থনৈতিক সূচক বিবেচনারও প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি।’


সিলেট বিভাগের পতনের নেপথ্যে সুনামগঞ্জ জেলা


সিলেট বিভাগের এই পতনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সুনামগঞ্জ জেলা, যা বহু বছর ধরেই দেশের সবচেয়ে বঞ্চিত জেলাগুলোর একটি। বর্তমানে এটি দেশের তৃতীয় দরিদ্রতম জেলা—পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন জেলা ও উপকূলবর্তী দূর্যোগপ্রবণ কক্সবাজার এলাকার পরেই সুনামগঞ্জের অবস্থান। 


২০১২ সালে সুনামগঞ্জের এমপিআই ছিল ০.২৮৯, তখন ৫৮.৯ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল এবং বঞ্চনার তীব্রতা ছিল ৪৯.১ শতাংশ। ২০১৯ সালে এসে অবস্থা কিছুটা উন্নত হলেও তেমন বড় পরিবর্তন আসেনি। এমপিআই নেমে এসেছে ০.২২৫, দারিদ্র্যের হার হয়েছে ৪৭.৪ শতাংশ, আর তীব্রতা ৪৭.৫ শতাংশ।


এই উচ্চ স্কোরের কারণে সুনামগঞ্জ পুরো বিভাগকে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। বিভাগের অন্যান্য জেলা সিলেট (০.১৫৭), হবিগঞ্জ (০.১৭৫) ও মৌলভীবাজার (০.১৪১) সূচক নিয়েও ভারসাম্য আনতে পারেনি। 


সূচকে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জে দারিদ্রের মূল নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রবণতা, পুষ্টির অভাব, নিরাপদ পানির সংকট, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা ও পারিবারিক সম্পদের ঘাটতি।


পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) দারিদ্র্য বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উইংয়ের যুগ্ম প্রধান ড. মুনিরা বেগম বলেন, “এই সূচক আয়ের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং সুবিধা প্রাপ্তির নির্দেশকে গঠিত। হাওরাঞ্চলের বিশেষ ভূপ্রকৃতি সিলেটকে পিছিয়ে দিয়েছে, যেখানে অন্য বিভাগগুলো ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে এগিয়ে গেছে।”


প্রবাসী আয়ে ঝলক, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন


বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগ প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স গ্রহণে দেশের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের পর তৃতীয় অবস্থানে আছে। তবে এই অর্থ মূলত বিভাগের নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতেই সীমাবদ্ধ এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনও দরিদ্রতা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সম্পদে প্রবেশাধিকার সংকটে জর্জরিত।


শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. রেজাই করিম খন্দকার বলেন, “এক সময় সিলেট ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ, দেশের সকলক্ষেত্রেই সিলেট অগ্রগণ্য ছিল। কিন্তু গত দুই দশকে সেই সমৃদ্ধি কমে এসেছে। তাই এখন সিলেটকে দরিদ্রতম বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত করা মোটেও অবাক হওয়ার মতো নয়।”


তিনি বলেন, “সিলেট ছিল শিক্ষা-সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। কিন্তু প্রবাসে যাওয়ার প্রবণতা ও সেই অর্থ স্থানীয় উন্নয়নে না খাটানোর ফলে এই অবস্থা। প্রবাসী আয় বেড়েছে, কিন্তু তা অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নে কাজে লাগেনি।”


সূচকের সুপারিশ কী বলছে


জাতীয় এমপিআই সূচক কেবল দারিদ্র্যের ব্যাপ্তি ও অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য প্রকাশ করছে না, বরং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বঞ্চনার আন্তঃসংযোগও তুলে ধরেছে।


সূচকটি সুনির্দিষ্টভাবে পরামর্শ দিচ্ছে, সিলেট বিভাগ ও বান্দরবান জেলার মতো দরিদ্র অঞ্চলে সম্পদ বরাদ্দ অগ্রাধিকার দিতে হবে, যাতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হ্রাসে গতি আনা যায়।


ড. এনামুল হক বলেন, “সূচক অনুযায়ী সারাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনো এসবের আওতার বাইরে। তাই দারিদ্র্য নিরসনে আলাদা নীতি প্রয়োজন এই অঞ্চলের জন্য।”


শেয়ার করুনঃ

বিশ্লেষণ থেকে আরো পড়ুন

সিলেট দারিদ্র্য, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক, MPI বাংলাদেশ, সুনামগঞ্জ দরিদ্র জেলা, সিলেট বিভাগের দারিদ্র্য হার, সিলেট প্রবাসী আয়, বাংলাদেশ দারিদ্র্য পরিসংখ্যান, পরিকল্পনা কমিশন MPI, সিলেট উন্নয়ন সংকট, হাওর অঞ্চলের দারিদ্র্য,