ঈদুল আজহা—আত্মত্যাগের অনন্ত আহ্বান
সম্পাদকীয়
প্রকাশঃ ৬ জুন, ২০২৫ ৮:০৫ অপরাহ্ন
‘ইবরাহিমের কাহিনী শুনেছ? ইসমাইলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরু-ছাগ?
আল্লার নামে ধর্মের নামে, মানবজাতির লাগি
পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
সেই মুসলিম থাকে যদি কেউ, তসলিম কর তারে,
ঈদগাহে গিয়া তারি সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।
অন্তরে ভোগী বাইরে সে যোগী, মুসলমান সে নয়
চোগা চাপকানে ঢাকা পড়িবে না সত্য সে পরিচয়।’
পবিত্র ঈদুল আজহা বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর জন্য শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং তা আত্মত্যাগ, আনুগত্য এবং মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য প্রতীক। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন—এই ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় ঈমানের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ কেমন হওয়া উচিত।
প্রতিবছর এই উৎসবে আমরা পশু কোরবানির মাধ্যমে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সে আত্মত্যাগকে স্মরণ করি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—পশু কোরবানির বাইরেও কি আমাদের অন্য কোন ‘পশু’ আছে, যার কোরবানি প্রয়োজন? কোরবানীর প্রকৃত অর্থ কী? মানুষের অন্তরের লালসা, অহংকার, হিংসা, হীনমন্যতা, জিঘাংসা, অন্যায়-অবিচার—এগুলোও তো একেকটি 'অন্তরের পশু', যেগুলো আমাদের ধ্বংস করে দেয় নীরবে, প্রতিনিয়ত।
আজকের সমাজে ঈদের আনুষ্ঠানিকতা জাঁকজমকপূর্ণ হলেও এর মূল বার্তা অনেকটাই নিস্প্রভ। আত্মত্যাগের দর্শনকে আমরা কতটা জীবনে ধারণ করতে পারছি? আমরা কি সমাজের দরিদ্র, নিপীড়িত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছি? ঈদের দিনে যারা নতুন পোশাক কিংবা এক মুঠো মাংসও জোগাড় করতে পারেন না, তাদের জন্য কি আমাদের হৃদয়ে সামান্য জায়গা আছে?
একবাক্যে উত্তর হতে পারে, না। আমাদের কাছে ঈদুল আজহা কিংবা কোরবানিরর ঈদ মানেই হাট-বাজার ঘুরে বাজেটের মধ্যে পছন্দসই একটি গরু-ছাগল কেনা, সেই পশুটিকে কোরবানী দিয়ে দুইভাগ মাংস বিতরণ করে চিন্তা করতে বসা যে দুপুরে বিরিয়ানি রান্না হবে না মাংসের রেজালা, বিকেলে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় কিংবা রাতে কী খাওয়া যায়।
কিন্তু কোরবানি মানেতো শুধুই পশু জবাই নয়—এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা। এটি নিজের স্বার্থ, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতালিপ্সা ইত্যাদি ব্যক্তিক ‘পশু’-কে বধ করার শপথ। যে মহান আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে, যে ত্যাগে নব্বইয়ের স্বৈরাচার নির্মুল হয়েছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে চব্বিশে পতন হয়েছে আরেক ফ্যাসিবাদের – এসবও তো কোরবানী।
এই কোরবানির মাহাত্ম্যকে কতজন ধারণ করতে পারছেন? এত বড় কোরবানি বা আত্মত্যাগের পরেও কী কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসছে? ঈদুল আজহার যে মাহাত্ম্য আমাদের শেখায় সমাজে ন্যায়বিচার, সাম্য এবং সহানুভূতির পরিবেশ তৈরি করা, তা কী অর্জন হয়েছে।
এই ঈদে আমরা যদি আমাদের ভিতরের অন্তত একটি পশুকে কোরবানি দিতে পারি—তবে কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য কিছুটা হলেও পূর্ণ হবে। সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, এবং আমাদের পারিবারিক জীবনে এই আত্মত্যাগের চেতনা প্রতিফলিত হলে তবেই ঈদুল আজহা হবে আমাদের কাছে এক প্রকৃত প্রশান্তির উৎসব।
ঈদুল আজহা, কোরবানির ঈদ, সম্পাদকীয়