তারুণ্যের উৎসবে সিলেটে জল্লাদিঘী পরিষ্কারে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী
ভিজ্যুয়ালস
ব্যবসায়িক সম্পর্কের আনুষ্ঠানিকতা ও লোকজ উৎসব আজ স্মৃতির পাতায়; ডিজিটাল লেনদেন ও ভোক্তাপ্রবণ সংস্কৃতিতে হারাচ্ছে এককালের জনপ্রিয় আয়োজন
প্রকাশঃ ১৪ এপ্রিল, ২০২৫ ৯:১৩ পূর্বাহ্ন
এক সময় বাংলা নববর্ষ মানেই ছিল হালখাতা—দোকানে নতুন খাতা খোলা, পুরনো পাওনা পরিশোধ, ক্রেতাকে মিষ্টি মুখ করানো এবং সম্পর্ক নতুন করে গড়া। সেই উৎসব আজ অনেকটাই ইতিহাস। বদলে যাওয়া ব্যবসায়িক ধারা, প্রযুক্তির প্রভাব আর লোকজ উৎসবের অবমূল্যায়নে হারিয়ে যেতে বসেছে এই বাণিজ্য-সংস্কৃতি।
হাল’ মানে নতুন, ‘খাতা’ মানে হিসাব। বাংলা শব্দ ‘হালখাতা’র উৎপত্তি এসেছে দুইটি শব্দ থেকে—‘হাল’ অর্থ নতুন এবং ‘খাতা’ অর্থ হিসাবের খাতা। পুরোনো বছরের পাওনা বা দেনা সংক্রান্ত হিসাব চুকিয়ে নতুন করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু করার এই রীতি চর্চা হতো বছরের প্রথম দিনে, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে।
লোকসংস্কৃতি গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক সুমনকুমার দাশ বলেন, “হালখাতা বাঙালির হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, যা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তার অংশ। একটা সময় গ্রামীণ জনপদ কিংবা শহরে সেখানে ব্যবসায়ী সমাজে হালখাতার প্রচলন ছিলো।”
তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীরা মোটা লাল খাতা সারাবছরের বাকির হিসাব লিখে রাখতেন এবং বছরের প্রথম দিকে পহেলা বৈশাখে ব্যবসায়ীরা হালখাতার আয়োজন করতেন, ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানাতেন এবং ক্রেতারা এসে আগের হিসেব মিটিয়ে নতুন খাতায় নাম লেখাতেন।”
সুমনকুমার দাশ বলেন, “আমার জন্ম গ্রামে, গ্রামের যাবতীয় সংস্কৃতির অংশ ছিল এটি। হিন্দু-মুসলিম ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে হালখাতার আয়োজন হতো। ছোটবেলায় আমরা বাবার সাথে বিভিন্ন দোকানে যেতাম, রঙিন কাগজে দোকান সাজানো হতো, নানা আয়োজন থাকতো। বনেদী ব্যবসায়ী মিষ্টি ছাড়াও দই-মাঠা রাখতেন। সেসব হারিয়ে গেছে। সেটা এখন অনেকটা মিস করি।”
সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকার বাসিন্দা এশাই মিয়া বলেন, “ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখে হালখাতা হতো, বাবার সঙ্গে লক্ষ্মী ভাণ্ডারে যেতাম। দোকানদার কাকু মিষ্টি দিতেন, নতুন খাতা খুলে বাবার নাম লিখতেন, বাবাও বাকি মেটাতেন, যদি থাকতো। তখন হালখাতা মানে উৎসব ছিল। এখন আর ওই দৃশ্য দেখি না।”
সিলেট নগরীর কালীঘাট, মহাজনপট্টি এলাকাসহ বিভাগের সকল পুরাতন বাজারহাটে হালখাতা ছিল এক বর্ণিল উৎসবের নাম। দোকানে দোকানে লাল মলাটে খাতা, ঝলমলে সাজসজ্জা, ক্রেতাকে মিষ্টান্ন পরিবেশন ও উপহার প্রদান ছিল রেওয়াজ। এমনকি অনেকে আমন্ত্রণপত্রও পাঠাতেন হালখাতার দিন উপলক্ষে।
কালীঘাট এলাকার ব্যবসায়ী নীলাঞ্জন দাশ টুকু বলেন, “আমি এখানে চল্লিশ বছর ধরে ব্যবসা করছি। যখন ছোট ছিলাম, তখন অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে হালখাতা হতো। একসময় আড়ম্ভরপুর্ণ ছিলো, কিন্তু দিনবদলের পালায় আগের উৎসব পাইনা, আনন্দও করতে পারি না।”
তিনি বলেন, “সিলেটের একটি বৃহত্তর ব্যবসায়ী কেন্দ্র কালীঘাট। আগে প্রতি দোকানে সাজসাজরব ছিলো হালখাতাকে কেন্দ্র করে। এখন আর বৈশাখের এক তারিখে আর হালখাতা হয় না। মাঝে মাঝে মাসদুই বা তিন পরে হালখাতা নামে ছোট করে অনুষ্ঠান আয়োজন করে কেউ কেউ।”
নববর্ষের লোকজ উৎসবগুলো এখন এক ধরনের করপোরেট উৎসবে পরিণত হয়েছে। ‘বৈশাখী অফার’, ‘ডিসকাউন্ট ফেস্ট’, ‘প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন’, ‘ক্যাশব্যাক’ —এসবই মূলধারার সংস্কৃতিকে ঢেকে দিচ্ছে। হালখাতার মতো ঐতিহ্য তাই হারিয়ে যাচ্ছে।
সিলেটের অভিজাত সুপারশপ ইউনিমার্ট’র অপারেশনস ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম পলাশ বলেন, “যেটা একসময় বাংলার প্রতিটা ঘরে ঘরে যে ট্রেডিশনাল আয়োজন ছিলো, সারাবছরের বাকীর হিসাবটা সেটা বছরের পহেলা দিনে শোধ করা হতো, সেই হালখাতা শব্দটির সাথেই এখনকার অনেকেই পরিচিত না।”
তিনি বলেন, “ডিজিটাল যুগে এখন বাকীতে বিক্রির ব্যবস্থাতো নেইই, তাছাড়া ক্যাশ পেমেন্ট তো হয়ই, বেশিরভাগ পেমেন্ট হয় ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, নগদ কিংবা বিকাশে– অর্থাৎ ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে।”
তবে এতসব হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে কালীঘাট-মহাজনপট্টির কিছু ব্যবসায়ী এবং গ্রামীণ অঞ্চলের কিছু হাটবাজারে হালখাতার চর্চা টিকে আছে ক্ষীণভাবে। দোকান মালিকরা নতুন খাতা কেনেন, সীমিত পরিসরে ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দেন এবং নবায়ন করেন সম্পর্ক ।
পহেলা বৈশাখ, হালখাতা, ঐতিহ্য, নববর্ষ,