ছবিঃ চা শ্রমিকদের মজুরি দিচ্ছেন এক ইউরোপীয়। ১৯০৩ সালে তোলা। ছবি কৃতজ্ঞতা : বোউর্ন এন্ড শেপার্ড

বাংলার চা–শ্রমিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় ‘মুলুক চলো’ আন্দোলন। ১৯২১ সালে সংগঠিত এই আন্দোলন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চা-বাগানে নিপীড়িত শ্রমিকদের আত্মমর্যাদার সংগ্রামকে সামনে নিয়ে আসে। 

এই আন্দোলন শুধুমাত্র শ্রম অধিকার রক্ষার আন্দোলন ছিল না, ছিল একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও মানবিক বিদ্রোহ— দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত চা শ্রমিকদের স্বদেশে ফেরার এক মরিয়া প্রত্যাশা।

উপনিবেশিক নিপীড়নের প্রেক্ষাপট


ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের শুরুতে ইংরেজ চা–উদ্যোক্তারা আসাম ও সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক চায়ের চাষ শুরু করেন। অত্যন্ত কষ্টসাধ্য এ কাজের জন্য স্থানীয় শ্রমিকদের অভাব থাকায় দালালদের মাধ্যমে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ শুরু হয়। 

‘চায়ের গাছে টাকা ওড়ে’-- এমন  মিথ্যা স্বপ্ন ও ভালো জীবনের আশ্বাস দিয়ে বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছোটনাগপুর ও সাঁওতাল পরগনা ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার আদিবাসী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসা হয় বর্তমানের আসাম ও সিলেট অঞ্চলের পাহাড়ি নির্জন চা-বাগানে। 

শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি ছিল তিন বছরের। কথা ছিল তিনবছর পর এককাড়ি টাকা নিয়ে দেশে ফিরবে তারা। কিন্তু বাস্তবে একবার চায়ের শ্রমে নিযুক্ত হবার পর তাঁরা আর মুক্তি পাননি। মানবেতর জীবনযাপন, অমানবিক পরিশ্রম এবং কোনো সাংবিধানিক অধিকার ছাড়াই তাঁরা কার্যত ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাবে জাগরণ


১৯২০ সাল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ডাকে অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সেই ডাকে প্রভাবিত হন চা–শ্রমিকরাও। তাদের মধ্যেও সচেতনতার ঢেউ ওঠে। সিলেটের বিপিনচন্দ্র পালসহ ব্রাহ্ম সমাজের মিশনারি ও জাতীয়তাবাদী কর্মীদের গোপন প্রচারে শ্রমিকদের মধ্যে নতুন আশার জন্ম হয়।

১৯২১ সালের ১ ও ২ মে চারগোলা ভ্যালির রাতারবাড়ি বাজারে কংগ্রেসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভা চা–শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান অসন্তোষ সেখানে নতুন মাত্রা পায়।


৩ মে: ইতিহাস গড়ার দিন


৩ মে আনিপুর চা–বাগানের ৭৫০ জন শ্রমিক স্ত্রী–পুত্রের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েন নিজ মুলুক বা দেশে ফেরার জন্য। আর সে ফিরতি যাত্রাকে বাধা দেয় বাগান কর্তৃপক্ষ। শুরু হয় এক ঐতিহাসিক মহানিষ্ক্রমণের অধ্যায়, যা ভারতের ইতিহাসের ‘চরগোলা এক্সোডাস’ নামে পরিচিত আর শ্রমিকদের কাছে ‘মুলুক চলো’। 

এরপর চারগোলা ও লঙ্গাই ভ্যালির আরও ১৯টি চা–বাগান থেকে হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে করিমগঞ্জ রেলস্টেশনের দিকে রওনা দেন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সংখ্যাটি ছিল ৮ হাজার ৭৯৯। ইউরোপীয় চা-মালিকদের চাপে পড়ে রেল কর্তৃপক্ষ টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেয়।  করিমগঞ্জ শহরের তখন লোকসংখ্যা মাত্র ৪,৫২২ জন কিন্তু শ্রমিক জড়ো হন ১২ হাজার। 

দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের নেতৃত্বে নারীরা ট্রেনে উঠার সুযোগ পেলেও পুরুষেরা হেঁটে যাত্রা করেন। ধীরে ধীরে সবাই জড়ো হতে থাকেন চাঁদপুর শহরে। এ সংখ্যা দ্রুতই ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যায় যখন সিলেট, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, শমশেরনগরসহ নানা অঞ্চলের বাগান থেকেও শ্রমিকেরা চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

তখন চাঁদপুরে মহকুমা প্রশাসক সুশীল কুমার সিংহ শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ালেও, ব্রিটিশদের পক্ষে প্রতিনিধি ম্যাকফারস আসার পর চিত্র বদলে যায়। 

২০ মে: ইতিহাসের রক্তাক্ত দিন


১৯ মে, যখন চা শ্রমিকরা নিজ মুলুকে ফেরার জন্য জাহাজে উঠতে থাকেন, তখন মহকুমা প্রশাসক সুশীল কুমার সিংহের নেতৃত্বে বাঁধা দেয়া শুরু হয় শ্রমিকদের। সশস্ত্র সৈন্যরা জাহাজে উঠতে থাকা শ্রমিকদের ওপর হামলা চালায়, সরিয়ে দেয় জাহাজের পাটাতন। শত শত শিশু, বৃদ্ধ ও নারী ভেসে যান মেঘনার জলে।


পরদিন ২০ মে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসেন ৫০জন গোর্খা সৈনিকদের একটি দল। সাথে জুড়ে যা ইউরোপীয় পাট মার্টেন্টরাও। চাঁদপুরে তখন হাজার হাজার চা শ্রমিক। রাতের শেষ ট্রেন স্টেশন ছাড়ার পর সরিয়ে দেয়া হয় রেলকর্মীদের। 

চট্টগ্রামের ডিভিশনাল কমিশনার কিরণচন্দ্র দের আদেশে রাতের অন্ধকারে ক্ষুধার্ত-ঘুমন্ত চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের উপর শুরু হয় গোর্খা সৈনিকদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। হাজার হাজার শ্রমিকের রক্তে ছেয়ে যায় চাঁদপুর রেলস্টেশন—এ দৃশ্য ভারতের উপনিবেশিক ইতিহাসে আজও এক কলঙ্কচিহ্ন।

এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের ৪,৫০০ কর্মচারীর নেতৃত্বে ২৪ মে থেকে আড়াই মাস ব্যাপী রেল ধর্মঘটের ডাক দেন। পাহাড়তলীতে ধর্মঘটের ফলশ্রুতিতে রেল কোয়ার্টার ফাঁকা হয়ে যায়। প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে এবং দেশপ্রিয়কে গ্রেপ্তার করে।

যখন ভারতবর্ষে এই আন্দোলনের মাতম, তখন মহাত্মা গান্ধী শ্রমিকদের এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে বিপরীতে অবস্থান নেন। ৮ জুন ১৯২১ তারিখে তিনি লেখেন, ‘শ্রমিকেরা মালিকদের ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাকে নেতৃত্ব দিতে কেউ যদি আমার নাম নিয়ে থাকে তাহলে আমি দুঃখিত। পুঁজি বা পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোনো অসহযোগিতা চলছে না। এক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা চলছে।’ ফলে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক সমর্থন হারিয়ে এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়।  

ঐতিহাসিক গুরুত্ব


চা–শ্রমিকদের এই মহানিষ্ক্রমণ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও ‘মুলুক চলো’ আন্দোলন শুধু একটি ঘটনার নাম নয়; এটি ব্রিটিশ উপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের আত্মমর্যাদার ঘোষণা। মুলুক চলো আন্দোলনের ১০৪ বছর পরও চা-শ্রমিক ঠিক কতখানি মুক্ত হয়েছেন, ঠিক কতটা স্বাধীন হয়েছে তা আজও এক প্রাতিষ্ঠানিক বিতর্ক।

আজ ২০ মে দিবসটির ১০৪ বছর পূর্তি হলেও চা শ্রমিকদের দাবি এই দিবসটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘চা শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ২১ মে আন্তর্জাতিক চা দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হলেও চা শ্রমিকদের ঘরে ফেরার জন্য অধিকারের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ আজও রয়ে গেছে ইতিহাসের বিস্মৃতির অন্তরালে।


শেয়ার করুনঃ

ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে আরো পড়ুন

মুলুক চলো আন্দোলন, চা শ্রমিক ইতিহাস, চরগোলা এক্সোডাস, ১৯২১ বিদ্রোহ, চাঁদপুর হত্যাকাণ্ড, ব্রিটিশ শাসন, সিলেট চা বাগান, শ্রমিক অধিকার আন্দোলন, চা শিল্প,