আজ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “সাহসী নতুন পৃথিবীতে সাংবাদিকতা — গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব”।


চ্যাটজিপিটি, কোপাইলট, ডিপসিকের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে, যেখানে সংবাদ তৈরি, বিশ্লেষণ ও পরিবেশনের প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, সেখানে এই প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী।


এই প্রযুক্তিনির্ভরতা যখন একদিকে সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে তা সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, বস্তুনিষ্ঠতা ও বৈচিত্র্যের ওপর নতুন ধরনের চাপও সৃষ্টি করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত অ্যালগরিদম যেখানে সংবাদ নির্বাচন করছে, সেখানে মানবিক অনুসন্ধান, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মাঠের গল্প ক্রমশ জায়গা হারাচ্ছে। 


এই প্রবণতা যত তীব্র হবে, তত ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্থানীয় সাংবাদিকতা—যা একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রান্তিক স্তম্ভ।


যেখানে রাজধানীকেন্দ্রীয় গণমাধ্যম কেন্দ্রনির্ভর সংবাদ ও বিতর্কে আবদ্ধ, সেখানে দেশের প্রান্তজনের কথা, প্রান্তিক জনপদের গল্প তুলে স্থানীয় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের দুর্দশা চোখে পড়ে না। 


তথ্য সংগ্রহে নেই আধুনিক প্রযুক্তি, নেই প্রশিক্ষণ বা গবেষণার সুযোগ। উপরন্তু, মাঠপর্যায়ে সাংবাদিকরা রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠী ও প্রশাসনিক হয়রানির মুখোমুখি হন। জর্জরিত হন রাজনৈতিক ও প্রতিহিংসামূলক মামলায়, রুদ্ধ হয় কন্ঠস্বর– —যা গণমাধ্যমের মৌলিক ভূমিকাকে ক্ষুণ্ন করে।


কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সাংবাদিকতা স্থানীয় গণমাধ্যমের জন্য সম্ভাবনা বয়ে আনলেও তা তখনই কার্যকর হবে, যদি সেই প্রযুক্তি স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তায় ব্যবহৃত হয়, তাঁদের প্রতিস্থাপন বা উপেক্ষা করতে নয়। এক অ্যালগরিদমের পছন্দ বা বড় শহরের খবরই যদি 'গুরুত্বপূর্ণ' বিবেচিত হয়, তবে তা জনসম্পৃক্ত সংবাদ ব্যবস্থাকে কৃত্রিম করে তুলবে। এতে হারিয়ে যাবে প্রান্তিক মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও সম্ভাবনার খবর।


এই প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় স্পষ্ট– স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে হবে; স্থানীয় গণমাধ্যমের টিকে থাকা ও মানোন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে; সংবাদ পরিবেশনে বৈচিত্র্য রক্ষা করতে জাতীয় গণমাধ্যমকে প্রান্তিক কণ্ঠস্বরের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে; এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন সাংবাদিকতার সহায়ক শক্তি হয়—বদলি নয়, সেটি নিশ্চিত করতে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।


সর্বোপরী, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনে স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম এবং প্রান্তিকে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য যে অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে।

এই বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক—প্রযুক্তিনির্ভর সাহসী পৃথিবীতে সাংবাদিকতার হৃদয় থাকবে মাঠে, জনগণের পাশে, এবং প্রান্তের কণ্ঠস্বরেই। কারণ, গণতন্ত্র কেবল তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতা, প্রতিবাদ ও প্রস্তাব গণমাধ্যমে জায়গা পায়—এবং তা নিঃশঙ্ক চিত্তে প্রচারিত হতে পারে।


শেয়ার করুনঃ

সম্পাদকীয় থেকে আরো পড়ুন

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস, মুক্ত গণমাধ্যম, সিলেট, সিলেট ভয়েস, সাংবাদিকতা, সাংবাদিক