ছবিঃ ফাইল ছবি

গতবছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই সিলেটের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরে লুটপাট শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলে কিছুটা বন্ধ হয় লুটপাট। তবে রেলওয়ে বাঙ্কার এলাকায় অব্যাহত ছিল লুটপাট। 

 

খোঁদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারের সামনে পাথর লুটপাটের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ সাদা পাথর লুটের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাক্ষী হিসেবে কেবল রাখা হয়েছে জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে। একইসাথে জাতীয় একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে।   

 

এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মৌলিক সাক্ষীর পরিবর্তে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে সাক্ষী করে এজাহার দায়ের করা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয় বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে এ ধরনের অযৌক্তিক কাজ পরবর্তীতে মামলাটির গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করবে বলেও ধারণা পরিবেশবিদদের।

 

এর আগে শুক্রবার (১৫ আগস্ট) পাথর লুটপাট ও চুরির ঘটনায় মামলা দায়ের করে খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। বিএমডির মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মোহাম্মদ আনোয়ারুল হাবিব বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় একমাত্র সাক্ষী হিসেবে রাখা হয় বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং টেলিভিশনের প্রতিবেদনকে। 

 

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১২ আগস্ট পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি হতে পাথর লুটপাটের ঘটনায় বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, বিভিন্ন টেলিভিশন নিউজকে সাক্ষী হিসেবে দেওয়া হয়েছে। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে যাওয়া এই পাথর লুটপাটের ঘটনায় সিলেটের জেলা, উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিজিবি বিভিন্ন সময় অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। এছাড়া এ সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সও বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করেছে। তাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্বশীলদের সাক্ষী না করে শুধুমাত্র গণমাধ্যমকে দালিলিক সাক্ষী করা এই মামলার দুর্বলতা হিসেবে গণ্য হবে বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

 

মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ আছে, অজ্ঞাতনামা কিছু দুষ্কৃতকারী ব্যক্তি কর্তৃক গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ পরবর্তী সময়ে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন গেজেটভুক্ত ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি হতে অবৈধ/অননুমোদিতভাবে সম্প্রতি কোটি কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে মর্মে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পাথর লুটপাটে অজ্ঞাতনামা আনুমানিক ১৫০০-২০০০ ব্যক্তি জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সরকারের গেজেটভুক্ত কোয়ারি হতে পাথর লুট/চুরি এ ধরনের কর্মকাণ্ড খনি ও খনিজসম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২ এর ধারা ৪(২) (ঞ) এবং খনি ও খনিজসম্পদ বিধিমালা, ২০১২-এর বিধি ৯৩(১) এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় মৌখিক নির্দেশনায় খনি ও খনিজসম্পদ (নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন) আইন, ১৯৯২ এর ৫ ধারা অপরাধে ও দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৯নং ধারা ও ৪৩১নং ধারায় অভিযোগ দায়ের করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায়, সরকারি নির্দেশনায় ও সরকারি স্বার্থে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন গেজেটভুক্ত ভোলাগঞ্জ কোয়ারি হতে পাথর লুট/চুরির দায়ে দায়ী (অজ্ঞাতনামা) ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।

 

এ বিষয়ে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেট-এর সদস্যসচিব আব্দুল করিম কিম জানান, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনকে মামলায় সাক্ষী হিসাবে উপস্থাপন করাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনকে এই লুটপাটের বিষয়ে কেন স্বাক্ষী করা হলো না? স্থানীয় প্রশাসনের সামনেইতো এই লুটপাট হয়েছে। তাই এ নিয়ে জনমনে প্রশ্নের অবকাশ রয়ে যায়। 

 

তিনি জানান, পাথর ইস্যুতে দায়িত্বশীলদের খামখেয়ালিপনা থাকলে পরবর্তীতে তা মামলার গ্রহনযোগ্যতা নষ্ট করতে পারে।

 

সিলেট জেলা বারের আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন জানান, এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শুধুমাত্র গণমাধ্যমকে সাক্ষী করা যুক্তিসঙ্গত নয়। শুধু দালিলিক, প্রচারমাধ্যম, ও গণমাধ্যম সাক্ষী নয়। মৌলিক সাক্ষী হিসেবে লুটপাটের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় মানুষদের দিতে হবে। পাশাপাশি ওই এলাকায় প্রশাসনিকগণ যারা আছেন তারা সাক্ষী হবেন। যেমন সংশ্লিষ্ট উপজেলা ইউএনও, ওসি, ভূমি কর্মকর্তাকে সাক্ষী করতে হবে এবং এই এজাহার সংশোধন করতে হবে। 

 

তিনি জানান, শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষী করে করা এই মামলা বিচারকের সামনে উপস্থাপন করলে মামলার ভিত নষ্ট হবে। কারণ স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ হলো দালিলিক সাক্ষী। একটি মামলার একমাত্র সাক্ষী শুধুমাত্র দালিলিক হতে পারে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় এ সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের গুরুত্ব বেশি। এ মামলায় জেলা প্রশাসকও সাক্ষী হওয়া উচিত। নিয়মে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এই মামলার আসামি হবে। কারণ এই খনিজসম্পদ সংরক্ষণ করার দায়িত্ব তাদের। তারা সংরক্ষণ করে নাই। এতে বুঝা যায় তারও এই লুটপাটে পরোক্ষভাবে জড়িত। 

Single News Bottom

শেয়ার করুনঃ

প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে আরো পড়ুন

মামলা দায়ের, সাদা পাথর, পাথর লুট, পরিবেশ, প্রশাসন