সিলেট বন্ধ পাথর কোয়ারি চালু প্রসঙ্গে আন্দোলন-রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে ঘিরে যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা দ্রুতই বহুপাক্ষিক স্বার্থের সংঘাতে বিপজ্জনক রূপ নিচ্ছে। পাথর উত্তোলন বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে কিছু শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধ হওয়ার শঙ্কা যেমন বাস্তব, তেমনি দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এই খাতে চলতে থাকা অনিয়ম, দুর্নীতি ও পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ডও অস্বীকারযোগ্য নয়। বর্তমান সংকটে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো—আমরা কোনটিকে বেশি অগ্রাধিকার দেব: প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জনস্বার্থ, না কি মুনাফালোভী চক্রের চাপের কাছে আত্মসমর্পণ?

দীর্ঘদিন ধরেই সিলেটের কোয়ারি অঞ্চলগুলো বেপরোয়া পাথর উত্তোলনের জন্য ‘বোমা মেশিন’সহ ভারী যন্ত্রের ব্যবহার ও হাজারো অবৈধ ক্রাশারের ব্যবহারে পরিবেশ ধ্বংসের এক জীবন্ত উদাহরণ হয়ে দাড়ায়। তার উপর, বৈধতার নামে ইজারা ব্যবস্থা এমন একপর্যায় রূপ নেয় যে জনসম্পদ হয়ে ওঠে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর একচেটিয়া সম্পদ। পরিবেশবিরোধী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে দিনেরাতে নদীশয্যা, নদীর পাড় ও পাহাড়-সমতল খুঁড়ে তুলে আনা হয় পাথর—নিয়ম না মানার এ উৎসব চালাতে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনও এক পর্যায়ে অসহায় বা নির্লিপ্ত থেকেছে, অথবা স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে গড়ে তুলেছে দুর্নীতির আখড়া। উপরন্তু, উচ্চ আদালতের বারবার নির্দেশনার পরও ‘ইজারা মাফিয়া’দের বিরুদ্ধে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা জনগণের চোখে পড়েছে।

এই বাস্তবতায় ও কোভিড মহামারীর প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার ২০২০ সালে যখন পাথর উত্তোলন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটিকে একতরফা বা অমানবিক বলার সুযোগ ছিল না। কারণ, পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিলো যেখানে ‘ব্যবস্থা না নিয়ে চলা’ মানে হতো দীর্ঘমেয়াদে সিলেট জেলার পরিবেশকে ধ্বংস করে দেয়া। তবে তবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই শুরু হয় এক নতুন লুটপাটের কর্মযজ্ঞ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে যাওয়ায় উত্থান ঘটে একদল নতুন লুটপাটকারীর। মাসখানেকের মধ্যেই লুটে নেয়া হয় অন্তত হাজার দুয়েক কোটি টাকার পাথর।

এসময়ের মধ্যে দেশের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দা রিজওয়ানা হক অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা হলে পরিবেশবাদীদের মনে আশার সঞ্চার হয় সিলেটের পরিবেশ রক্ষায় স্থায়ী উদ্যোগের বিষয়ে। তবে প্রথমে সরকার আওয়ামী আমলের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দিলে নিরাশা সৃষ্টি হয়। এ সুযোগে নতুন ইজারা দেয়া না হলেও শুরু হয় প্রকাশ্য ধ্বংসযজ্ঞ, ধারাবাহিকভাবে লুট হতে থাকে সকল পাথর কোয়ারি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পাথর। একসময় টনক করে সরকারের, স্থায়ীভাবে ইজারা প্রক্রিয়া বাতিল করে দেয়া হয়, স্বস্থির নিশ্বাস ফেলেন পরিবেশকর্মীরা।

এই নিষেধাজ্ঞা শুধু পরিবেশ রক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত নয়—এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোরও একটি পথ। কারণ, এই খাতের অধিকাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে একটি স্বল্পসংখ্যক মুনাফাভোগী গোষ্ঠী, যারা শ্রমিকদের নাম ব্যবহার করে আন্দোলনের মোড়কে নিজেদের ইজারা পুনর্বহালের চেষ্টা চালাচ্ছে। বাস্তবতা হলো—মালিক-শ্রমিক ঐক্যের নামে এই আন্দোলনে শ্রমিকের চাইতে মালিকের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

আর এই মালিকস্বার্থ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে যে গত ১৪ জুন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জাফলং পরিদর্শন শেষে ফেরার পথে তাদের গাড়ি আটকে দেন নতুন উত্থান হওয়া প্রভাবশালী ও তাদের অনুসারীরা। তবে এই আটকে দেয়ায় অনেকটা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় পরিবেশরক্ষায় সরকারি উদ্যোগের জন্য। এই ঘটনার পর থেকে সিলেটে স্থানীয় প্রশাসনের দৃশ্যমান কিছু কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। অন্তত ৩০০ অবৈধ পাথর ভাঙা কলের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, অনেকাংশেই কমে আসে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কর্মযজ্ঞ।

তবে সরকারের এই প্রতিক্রিয়ার আবার বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে সিলেটে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সিলেট জেলা পাথর–সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। এই পরিষদের ডাকে গত ২৪ জুন থেকে ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়েছে নানা আন্দোলন কর্মসূচি। এমনকি এসকল কর্মসূচির মধ্যে মঙ্গলবার পর্যটকবাহী গাড়িতেও হামলা হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। বুধবার ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটের জেলা প্রশাসকের অপসারণসহ ৫ দফা কর্মসূচি, নয়তো শুরু হবে পণ্য ও গণপরিবহনের ধর্মঘট। সব মিলিয়ে সিলেটের সার্বিক অবস্থা অনেকটাই টালমাতাল। 

রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি একত্র হয়ে পাথর মহাল চালুর পক্ষে সরব হয়েছে। পাথর শ্রমিকদের নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয়, জেলা এমনকি মহানগরের নেতৃবৃন্দ, যদিও পাথর শিল্পের সাথে মহানগর বিএনপির কোন সরাসরি সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে না। তবুও সবাই শ্রমিকদের স্বার্থের দোহাই দিয়ে এই আন্দোলনের পালে হাওয়া দিচ্ছেন। 

তবে আওয়ামী আমলে পাথর তুলতে গিয়ে শতাধিক পাথর শ্রমিক নিহত এবং সহস্রাধিক পাথর শ্রমিক পঙ্গুত্ব বরণ করলেও তৎকালীন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট পাথর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিরোধী কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। ২০২১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড পাওয়া সিলেট ভয়েসের প্রতিবেদক শাহ শরীফ উদ্দিনের পাথরের সিন্ডিকেট বিষয়ক সাতপর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে রয়েছে কী বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো আওয়ামী আমলের পাথর লুটেরারা।

এখানে উল্লেখ্য যে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ—তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটি কোনোভাবেই এমন একটি খাত টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা হতে পারে না, যার বুনোট জুড়ে আছে পাথর শ্রমিকদের রক্ত, শোষণ, দুর্নীতি, অবৈধতা এবং পরিবেশবিনাশ।

সম্প্রতি সিলেট ভয়েসে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন কবি ও তাত্ত্বিক প্রাবন্ধিক ইকবাল কাগজী। সেখানে তিনি কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছেন যা গুরুত্বপূর্ণ।  তিনি দাবি তুলেছেন একটি নতুন নীতিমালার।  চলমান অস্থিরতা এবং সরকারের দৃঢ়তার মধ্যে এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী দাবি।


সুপ্রাচীনকাল থেকে সিলেটের সীমান্তবর্তী নদ-নদী থেকে পাথর উত্তোলন হতো সনাতন পদ্ধতিতে, কোন যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই। আধুনিক ইজারা প্রথা বাতিল করে সরকার সরাসরি সনাতন পদ্ধতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারেন। তবে ইজারা প্রক্রিয়ায় নয়, বরং সরকারি পাথর-বালু ক্রয়কেন্দ্র পরিচালনার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে শুধুমাত্র স্থানীয় শ্রমিকদের দেয় অনুমোদনের মাধ্যমে সীমিত উত্তোলনের সুযোগ রাখা যেতে পারে। তবে সার্বিক ব্যবস্থাপনা হবে স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশবিদদের যৌথ তত্ত্বাবধানে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোথা থেকে, কী পরিমাণ পাথর তোলা হবে, কে তুলবে, কত টাকায় বিক্রি হবে—এইসব বিষয়ে একটি আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

এখন আর কেবলমাত্র পাথর মহাল খোলা বা বন্ধ রাখার দ্বিধা নয়—মূল প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কী আদৌ একটি টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় যেতে পারবো?

সার্বিক বিবেচনায় স্পষ্ট যে, পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বর্তমান বাস্তবতায় সময়োপযোগী ও জনস্বার্থ-সম্মত। এটি শ্রমিকবান্ধব নাও হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার পথ তৈরি করতে পারে—যদি আমরা এখন থেকেই ন্যায্য, পরিবেশবান্ধব এবং স্বচ্ছ বিকল্প ব্যবস্থাপনায় যাই। শ্রমিকের নামে যারা পরিবেশ ধ্বংস করে মুনাফা লুটেছে, এবং ভবিষ্যতে লুটপাটের সংস্কৃতিক সচল রাখতে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করছেন, তাদের প্রতিহত করে প্রকৃতি ও মানুষের জন্য টেকসই একটি সমাধানের পথে আমাদের হাঁটতেই হবে। 


সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি দ্রুত সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। একই সাথে সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি আহবান লুটপাটের সঙ্গী হতে হয়, প্রকৃত জনবান্ধব-শ্রমবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়নে সরকারকে সমর্থন জোগানোর।

Single News Bottom

শেয়ার করুনঃ

সম্পাদকীয় থেকে আরো পড়ুন

সিলেট, সিলেট ভয়েস, পাথর কোয়ারি, সম্পাদকীয়, পাথর শ্রমিক