সময় বদলায়, বদলায় যুগ। পাল্টে যায় মানুষের রীতিনীতিও। তবে কিছু কিছু স্মৃতি আছে, যা সময় যতই পেরিয়ে যাক মনে রয়ে যায় গভীর রেখাপাত করে। ঠিক যেমন একসময় বিয়েবাড়ির প্রাণ ছিল যে কলাগাছের গেইট, আজ তা শুধু স্মৃতির জানালায় ঠাঁই পেয়েছে।

আজকের ডিজে, স্পটলাইট আর ঝলমলে ডেকোরেটরের আয়োজনের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ বিয়ের সেই সরল, প্রাণবন্ত আমেজ। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে, যেখানে ৮০–৯০ দশকের বিয়েগুলো ছিল আপন ঘরের একান্ত উৎসব।

তখন গেইট বানানোর প্রধান উপকরণ ছিল কলাগাছ, বাঁশ আর রঙিন কাগজ। পাড়া-প্রতিবেশীরা মিলে যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গেইট বানাত, তাতে যেন উৎসবের শুরুই হতো ওই নির্মাণ দিয়ে। কেউ বাঁশ কাটত, কেউ কলাগাছ টানত, কেউবা রঙিন কাগজ দিয়ে পাখা, শিকল, নিশান বানিয়ে সাজাত গেইট।

বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কিরফান আলী স্মৃতিচারণা করে বলেন, 'ছেলে, এখনকার বিয়েতে হইল ধুমধাড়াক্কা, কিন্তু সেই টান নাই। বর আইলে বুক ধপধপ করত। কলাগাছের গেইট বানাইতে গেলে লগে লগে গোটা পাড়া এক হইয়া যাইত—সেইখানেই আছিল আসল আনন্দ।'

বিয়ের আগের রাতগুলো ছিল পিঠা বানানোর মহোৎসব। জামাই পিঠা, নকশি পিঠা, কাটাকুটি কিংবা চিতই বাড়ির মেয়েরা মেতে উঠত দল বেঁধে। উঠানজুড়ে হাসি-ঠাট্টা, গল্প আর গান চলত রাতভর। 'বউ আইলো লাজে রাঙ্গা, মুঞ্জি পাতার কুড়ান ফাঙ্গা' এই গানের সুরে জেগে থাকত এক প্রজন্ম।

গ্রামের আরেক বৃদ্ধা ফুলবাহার বিবি বলেন, 'বিয়া মানেই আছিল মিলনমেলা। বর আইলে নাওত লইয়া আসত, ছাউনি দিত নিশান দিয়া, বাজি ফোটাইত। এখন তো বিয়া হইল সিনেমার শুটিংয়ের মতন!'

বরযাত্রীরা অনেক সময় নদীপথে যেত কনে বাড়ি। নৌকাও সাজানো হতো কলাগাছ, পাটপাতা আর রঙিন কাগজে। তখন মাইকের জোর ছিল না, কিন্তু বাজত বাঁশির সুর, লোকগান, আর হৃদয়ের টান।

এক সময়ের জনপ্রিয় প্রবাদের কথা: “বিয়া বউয়ের লাজ, আর গেইট পাড়ার গরিমা।” আজ সেই লাজও নেই, গরিমাও।

এখন বিয়ের গেইট বানায় পেশাদার ডেকোরেটর। ডিজে’র সাউন্ডে হারিয়ে যায় গীতের সুর। কেউ আর পাড়ায় ডাক দেয় না—“আলি ভাই, গেইট বানাইতে আসেন।” কলাগাছেরও যেন এখন আর খোঁজ মেলে না।

পাড়ার মানুষদের কাছে গেইট বানানোর শেষ আনন্দ ছিল বরপক্ষের দেওয়া এক কাপ চা আর হালুয়া। “চা দিয়া খুশি, হালুয়া দিয়া তৃপ্ত” এই ছিল বিয়ের আসল নিমন্ত্রণ।

আজ সেই ঐতিহ্য গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে গল্প হয়েই বেঁচে আছে। নতুন প্রজন্ম বিশ্বাসই করবে না, একটা সময় ছিল, যখন গেইট বানানো মানেই ছিল পাড়া-মহল্লার উৎসবের সূচনা।

বিয়েবাড়ির সেই প্রাণের উল্লাস, পিঠা-পুলি আর কলাগাছের গেইট সব আজ শুধু স্মৃতির পাতায়। আধুনিকতার ঢেউয়ে ভেসে গেছে এক সময়ের আবেগঘন গ্রামীণ বিয়ের দৃশ্যপট।

Single News Bottom

শেয়ার করুনঃ

ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে আরো পড়ুন

কলাগাছ, ঐতিহ‍্য, হবিগঞ্জ, বিয়েবাড়ি