তিন কারণে এবার চামড়া নিয়ে আগ্রহ নেই সিলেটের ব্যবসায়ীদের
ব্যবসা-বাণিজ্য
প্রকাশঃ ০৬ জুন ২০২৫
‘ইচ্ছেমতো’ দর নির্ধারণ, প্রতিকূল আবহাওয়া ও ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া পড়ে থাকার কারণে এবার চামড়া নিয়ে আগ্রহ নেই সিলেটের ব্যবসায়ীদের। এতে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের এমন অনাগ্রহের কারণে মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়তে পারেন। এতে বড় ধরণের ধস নামতে পারে চামড়া ব্যবসায়।
চামড়া ব্যবসায়ীদের দাবি, গত ১৫ বছর ধরে সিন্ডিকেটে জিম্মি চামড়া ব্যবসা। এবারও তাই। ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা না করে ইচ্ছেমতো দর নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সারা বছর লোকসান গুণে ঈদে এসেও একই অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় তাদের। তাছাড়াও ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে সিলেটের ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া রয়েছে। এর বাইরে সিলেটে বৃষ্টিপাতের কারণে অনুকূলে নেই আবহাওয়া। এ অবস্থায় নতুন করে চামড়া ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না তারা।
রাত পোহালেই পবিত্র ঈদুল আজহা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে এবার সিলেট জেলায় কোরবানিযোগ্য পশুর চাহিদা ১ লাখ ২ হাজার। কোরবানির পর প্রতিবছরই পশুর চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এরপর তা প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করেন ঢাকার ট্যানারিগুলোতে।
এ বছর সরকার নির্ধারিত দর অনুযায়ী ট্যানারি ব্যবসায়ীরা ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় কিনবেন; গত বছর এই দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৫৫ টাকা ৬০ টাকা গতবছর যা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ছিল।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, যা গত বছর ছিল ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা। আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ থেকে ২২ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা।
এছাড়া এ বছর প্রতি বর্গফুটে চামড়ার দামের পাশাপাশি ছোট গরুর আয়তন হিসেবে লবণযুক্ত চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১১৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এ দাম ঢাকায় হবে ১৩৫০ টাকা।
সিলেটের চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোরবানীর ঈদের পশু ছাড়া সারা বছর সিলেটে প্রতি পিস গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কেনা হয়। কোনটি আবার ৬০০ টাকায়ও বিক্রি হয়। এগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণে আরও খরচ পড়ে। সবশেষে এগুলো ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। কেনা দামেও অনেক সময় তারা নিতে চান না। বাধ্য হয়ে তাদের কাছে এগুলো বিক্রি করতে হয়। এক বছরের টাকা পরের বছর দেওয়ার শর্তেও অনেক সময় চামড়া ছাড়তে হয়।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সিলেটের চামড়া ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। অন্যদিকে এ বছর ব্যাংক থেকেও লোন পাননি ব্যবসায়ীরা। সব মিলিয়ে তলানিতে এসে ঠেকেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে করে চামড়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। তবুও এই ব্যবসা চালিয়ে যাওয়র কথা বলেছেন কেউ কেউ।
চামড়া ব্যবসায়ী মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘২০১৪ সালের ১ কোটি টাকা এখনও ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া পড়ে আছে। গত বছরের আরও ৮ লাখ টাকা বকেয়া। এ অবস্থায় নতুন করে বিনিয়োগ করার আগ্রহ নেই। তবুও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যতটুকু সম্ভব ততটুকু বিনিয়োগ করবো।’
তিনি আরও বলেন, সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করে একরকম। কিন্তু ট্যানারি ব্যবসায়ীরা অর্ধেক দামে চামড়া কিনতে চান। গত বছর সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করলেও ট্যানারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হয়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে। বিগত কয়েক বছর ধরে এভাবেই সিন্ডিকেটে জিম্মি এই ব্যবসা।’
সিলেট শাহজালাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির কার্যকরি সদস্য হামিদ আহদ বলেন, ‘গত বছরের লবনযুক্ত অন্তত ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার খাসির চামড়া গোদামে প্রক্রিয়াজাত করে রাখা। এগুলো ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে কেনা। আর প্রক্রিয়াজাত করতে আরও খরচ পড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এখন প্রতি পিস ২০ টাকা দরে নিতে চাচ্ছে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা। এই পরিস্থিতিতে আর চামড়া কেনার সাহস হারিয়ে ফেলেছি।’
তিনি বলেন, ‘এবার শেষবারের মতো চামড়ার ব্যবসা করবো। এবছরও যদি লোকসান গুণতে হয় তাহলে আর চামড়ার ব্যবসা ছেড়ে দেবো। সরকার এই ব্যবসা করুক।’
বিগত চার-পাঁচ বছরে সিলেটে চামড়া ব্যবসায়ী অর্ধেকে নেমে এসেছে উল্লেখ করে শাহজালাল চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শেখ শামীম আহমদ জানান, ’দাম কমে যাওয়া, বকেয়া পড়ে থাকা, সরকারের সমন্বয়হীনতার কারণে এই ব্যবসা থেকে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নানা জটিলতার কারণে এখন চামড়া ব্যবসায় আগ্রহ নেই সিলেটের ব্যবসায়ীদের। বছরের পর বছর লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদেরকে। সরকার উদ্যোগ না নিলে এক সময় এই ব্যবসায় আর কেউ থাকবে না।’
চামড়া, কোরবানি, দর, সিলেট, ট্যানারি ব্যবসায়ী