চায়ের দেশ খ্যাত ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট। অসংখ্য ছোট-বড় চা বাগানে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী এ ফসল নিয়ে অধিকতর গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সমৃদ্ধ করতে ২০০৪ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘টি টেকনোলজি’ বিভাগ। কালের পরিক্রমায় আর প্রয়োজনের আবর্তে বর্তমানে এ বিভাগের নাম ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টি টেকনোলজি।

প্রতিষ্ঠার পর চা গবেষণা ও উদ্ধাবনে বিভাগটি গত ২১ বছরে কী উপহার দিয়েছে তা জানেন না অনেকেই। আবার দীর্ঘ এ পথচলায় নানা সমস্যা, সম্ভাবনা ও সংকটেও রয়েছে উচ্চতর চা শিক্ষায় দেশের একমাত্র এই বিদ্যায়তন।

আন্তর্জাতিক চা দিবসে এ বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপকালে উঠে এসেছে বিভিন্ন বিষয়। জানা গেছে বিভাগের চলমান বিভিন্ন সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা ও অত্যাধুনিক সব উদ্ভাবনের কথা।

২০০৪ সালে দেশের প্রথম ‘টি টেকনোলজি বিভাগ’ হিসেবে যাত্রা শুরুর পর ২০০৬ সালে নামকরণ করা হয় ‘ফুড এন্ড টি টেকনোলজি’ নামে। এর পরে কারিকুলামে যুক্ত হয় প্রকৌশল, ২০১০ সালে নতুন নামকরণ হয় ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টি টেকনোলজি নামে। বিভাগটি বর্তমানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করছে। 

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভাগটি ফুড প্রসেসিং ও এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রির সাথে সাথে চা গবেষণায় বেশ সাফল্য বয়ে আনছে। চা ব্যবহারকে আরো স্বাস্থ্যকর করতে তুলতে চা প্রসেসিং, চায়ের উপাদান ও ফ্লেভার মিশ্রণে বিভিন্ন পণ্য তৈরি, চা সম্পর্কিত জৈব ও অর্গানিক রসায়নের প্রয়োগ, খাদ্য ও চায়ের মাইক্রো-বায়োলজির প্রয়োগ, চা উৎপাদন প্রযুক্তি, টি বেভারেজ টেকনোলজি, ফুড ও টি বায়ো-টেকনোলজি, টি পেস্ট ম্যানেজমেন্ট, টি প্লান্ট প্যাথোলজি, টি প্লান্ট ইকোলজি, জেনেটিক্স এন্ড ব্রিডিং, নতুন নতুন চায়ের জাত উদ্ধাবন, টি টেস্টিং, ব্লেন্ডিং ও কোয়ালিটি নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে বিভাগটি।  

বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সাজিদ মাহমুদ বলেন, ‘বিভাগে মোটামুটি ভাল ল্যাব সুবিধা আছে, যাতে বেসিক কাজগুলো করা যায়। একটা এক্সপেরিমেন্টাল টি গার্ডেন আছে, ওয়ার্কশপ আছে। যা গবেষণায় ভাল কাজে লাগছে। প্রতি ব্যাচে ১০-১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী চায়ের উপর বিশেষায়িত পাঠ পছন্দের তালিকায় রাখছেন। আরও সুবিধা যুক্ত করা হলে শিক্ষার্থীরা চা গবেষণায় আরও আগ্রহী হবেন।’ 

বিভাগের সাফল্য নিয়ে অধ্যাপক ড. জি এম রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চা এর ইনগ্রেডিয়েন্ট বা উপাদানকে ব্যবহার করে বিভিন্ন খাবার তৈরি করছে। কারণ চায়ে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া এর যে ফাংশনাল প্রোপার্টি আছে সেগুলো শরীরের জন্য উপকারী।’ 

তিনি বলেন, ‘শুধু চা উৎপাদনে সীমাবদ্ধ না থেকে আমরা বিভাগে এমন গবেষণা পরিচালনার উদ্যোগ নিচ্ছি, যাতে চা এর উপাদান ব্যবহার করে অন্যান্য কোমল পানীয় বা শুকনা খাবার তৈরি করতে পারি। এছাড়া আমাদের নজর দেওয়া দরকার চা উৎপাদন, প্রসেসিং এ ভিন্নতা এবং এর সমৃদ্ধিতে অধিকতর গবেষণা ও চা ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সাথে সংযুক্ত হওয়া প্রয়োজন।’

বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতেখার আহমদ বলেন, ‘গবেষণা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ২০০৪ সালে বিভাগটি চালু হলেও শেষ ১০ বছরে আমরা চা নিয়ে গবেষণায় বেশ সাফল্য পেয়েছি। আমাদের বেশকিছু গবেষণা হয়েছে, যার মধ্যে চায়ের পেস্টিসাইড গবেষণা অন্যতম।’ 

তিনি বলেন, ‘এছাড়া আমরা বেশ কিছু শরীরের জন্য উপকারী এমন ফ্লেভার ও ব্লেন্ড যুক্ত করে গবেষণা করেছি। এর মধ্যে রয়েছে মরিঙ্গা টি, চকলেট টি, আলমন্ড টি, মাশরুম টি, আদা টি, বে লীফ টি, মিক্সড স্পাইসি টি, ক্লোভ টি, লেমন মাল্টা টি, স্ট্রবেরি টি, ককটেল টিসহ বিভিন্ন মসলা যা শরীরের জন্য উপকারী। এছাড়া মোজে, স্প্রাইট, কোকাকোলার মতো বেভারেজের বিকল্প হিসেবে আমরা চা এর ফ্লেভার যুক্ত করে কার্বোনেটেড বেভারের টি-কোলা তৈরি করেছি, যা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করার মতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে একটা প্রজেক্টের অধীনে চা এর গবেষণায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) যুক্ত করার চেষ্টা করছি। চা সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগ সনাক্তে কাজ করেছি। বিভিন্ন প্রসেসের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের মধ্যে এআইয়ের সহায়তায় রোগ সনাক্তের লক্ষ্যে ফিল্ড থেকে স্যাম্পল নিয়ে এ গবেষণা চলছে।’ 

গবেষণা বরাদ্দের সংকটের পাশাপাশি গবেষক ও আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংকটের কখা উল্লেখ করে এ শিক্ষক বলেন, ‘বিভাগের ১০শতাংশ শিক্ষার্থীও চা নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী নয়। আর আগে যারা ভাল কাজ করেছেন তাদের বেশিরভাগই দেশের বাইরে চলে গিয়েছেন। ফলে প্রজেক্টগুলো পুণরায় পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে।’

গবেষণা-উদ্ভাবনে সাফল্য নিয়ে বিভাগটির প্রধান অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘অসংখ্য গবেষণা হয়েছে চা নিয়ে, যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিভাগটি মূলত ফুড প্রসেসিং নিয়ে বেশি কাজ করে, এর মধ্যে চা আছে। চায়ের গাছ বা পাতা থেকে প্রসেসিং হয়ে ফাইনাল পণ্য পর্যন্ত এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাল মানের গ্রাজুয়েট প্রতিবছর বের হচ্ছে, যারা দেশে বিদেশে এ অঙ্গণে ভূমিকা রাখছেন। অনেকে চা বাগান বা চা ইন্ডাস্ট্রিতে ম্যানেজার, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজারসহ বিভিন্ন পদে সরাসরি যুক্ত হয়ে কাজ করছেন।’

বিভাগের সংকট রয়েছে জানিয়েছে বিভাগীয় প্রধান জানান, গবেষণা পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ বা চাকরির নিশ্চয়তা না থাকায় শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই চা নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী না, তারা সরাসরি ফুড প্রসেসিং ফিল্ডে যুক্ত হতে চায়। সরকার, দেশীয় বিভিন্ন চা প্রতিষ্ঠান, চা বোর্ড কিংবা বিদেশী সংস্থার পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ থাকলে চা গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাজেদুল করিম বলেন, ‘এ অঞ্চলের চা শিল্পের কথা গুরুত্বের সাথে মাথায় রেখেই বিভাগটি সেসময়ে খোলা হয়েছিলো। এখানে এ যাবত বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, এখনো চলমান রয়েছে। এছাড়া চা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তরেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন এবং করেছেন। আমি মনে করি এর মাধ্যমে চা শিল্প উপকৃত হচ্ছে।


শেয়ার করুনঃ

তথ্যপ্রযুক্তি-শিক্ষা থেকে আরো পড়ুন

সিলেট, চা গবেষণা, টি টেকনোলজি, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাবিপ্রবি, আন্তর্জাতিক চা দিবস, চা উদ্ভাবন,